Last updated on December 2nd, 2023 at 12:39 pm
জারবেরা তার নিজের সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। জারবেরা বিদেশী ফুল হলেও বর্তমানে আমাদের দেশে এই ফুলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে । বর্তমানে দেশী প্রজাতির ছাড়াও টিসুকালচারের মধ্যমে উন্ন্যত মানের জারবেরা ফুল আমাদের দেশে চাষ সম্ভব হয়ে উঠেছে। শীতকালের পাশাপাশি গরমকালেও যথাযথ যত্ন এবং পরিচর্যা করলে গাছ থেকে আপনারা সারা বছর ফুল পেতে পারেন।
গোলাপের পরে রূপ ও রঙের বৈচিত্রে, জারবেরার জুড়ি মেলা ভার। প্রচন্ড শীতে গাছে তেমন একটা ফুল ফুঁটতে দেখা যায় না কিন্তু বসন্তের শুরুতে-ই গাছ ফুলে ভোরে যায়। তাই আপনি চাইলে বাড়িতে উঠোনে, ছাদের টবে খুব সহজেই জারবেরা ফুল চাষ করতে পারেন । ফুলদানি সাজাতে, ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে,বিয়ের গাড়ি সাজানো অথবা রিসেপশনের ফুলের তোরা এবং ফুলসজ্জার খাট সাজানো সবেতেই জারবেরার অবাধ বিচরণ ।
জারবেরা গাছের সম্পূর্ণ পরিচর্যা | Gerbera Plant Care
জারবেরা কম্পোজিটি পরিবারের অন্তভূক্ত ফুল। জার্মান প্রকৃতিবিদ ট্রানগোট জার্বার এর নামানুসারে ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে জারবেরা। গাছ গুলি বহুবর্ষজীবি এবং কান্ড হীন হয় এবং এর উচ্চতা সর্বাধিক 1 ফুঁট (30-50 সে.মি.পর্যন্ত ) হতে পারে। ফুলগুলি একক বর্ণের অথবা বহু বর্ণময় হতে পারে। ফুলের দন্ড বেশ লম্বা হয়।
জারবেরা গণের আওতায় 40 টির মত প্রজাতি আছে। এ গুলির মধ্যে জারবেরা জ্যামেসোনি প্রজাতিটি চাষাবাদ হচেছ সংকরায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে।
চারা গাছ সংগ্রহ:-
নার্সারির থেকে ফুল সহ গাছ কিনলে ফুলের দন্ডটি কেটে তবেই গাছ লাগাবেন অথবা ফুল শুকিয়ে যাওয়ার পর লাগাবেন। কখনোই পাতার কোনা পঁচা, পাতায় কালো বা ছোঁপ-ছোঁপ দাগ, পাতায় জলের মতো দাগ অথবা কোঁকড়ানো বড়ো পাতা জাতীয় গাছ নেবেন না এগুলো সবকটি গাছের রোগ। গাছ কেনার সময় অবশ্যই নীরোগ, সুস্ত-সবল গাছ কেনার চেষ্টা করবেন। আর গাছ বাড়ি এনে পটিং করার আগে জলের মধ্য ফাঙ্গিসাইড গুলে 10 থেকে 20 মিনিটের রেখে দেবেন অথবা মার্টির সাথে অল্প পরিমান ফাঙ্গিসাইড মিশিয়ে নেবেন। জারবেরা গাছ সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে যথাক্রমে গাছের গোড়া থেকে বেরোনো দেশী জারবেরা আর একটা টিস্যুকালচার এর জারবেরা। দেশী জারবেরা দাম 20 থেকে 40 আর টিসুকালচার এর 50- 80 নেয় জায়গা বিশেষে। টিস্যুকালচার গাছের তুলনায় দেশী গাছের ফুল হয় বেশি হয়,গাছ গুলিও খুব হার্ডি হয় এবং রোদ জলে বিশেষ অসুবিধা হয় না তবে যদি টিস্যুকালচার গাছ কিলনে ওকে গরমের সময় অল্প রোদ পায় এমন জায়গায় আর বর্ষার সময় বৃষ্টির জল থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
জারবেরা গাছের জন্য মাটি তৈরী :-
জারবেরা গাছের জন্য এমন মাটি তৈরি করতে হবে যাতে আর্দতাও থাকবে অথচ মাটিতে জল ও দাঁড়াবে না। জারবেরা ফুল( gerbera full) চাষের জন্য মাটির পি এইচ মান 5.5 থেকে 6.5 এর মধ্যে হওয়া দরকার । জারবেরার জমিতে প্রচুর জৈব সার থাকা দরকার এজন্য প্রচুর পরিমানে গোবর সার, পাতাপচা সার ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত এক মিটার গভীর মাটির স্তর জারবেরা চাষের উপযুক্ত।
জারবেরা চাষের জন্য মাটি নিতে হবে 50%, 1 বছরের পুরোনো গোবরসার অথবা 1 বছরের পুরোনো পাতা পাঁচা সার অথবা ভার্মি কম্পোস্ট নিতে হবে 20% এবং বালি মেশাতে হবে 10 % (একটু মোটা দানার লাল বালি জলে ধূয়ে নিতে হবে অথবা যেমন বালি পাবেন), কোকোপিট অথবা ধানের চিটে 10%, হাড়গুড়ো, সিংকুচি ও নিমখোল এর মিশ্রণ আর মাটির সাথে 2 চামচ পাতা পোড়ানো ছাই মেশাতে পারলে ভালো হয় ছাই যেমন গাছ কে পটাসিয়াম এর যোগান দেবে এবং গাছ কে রোগ মুক্ত রাখবে এবং মাটিকে অম্লিক বা এসিডিক হতে দেবে না। এই সমস্ত কিছু এক সাথে মিশিয়ে নিয়ে 8 ইঞ্চি টবের ক্ষেত্রে এক চামচ সুপার ফসপেট মাটির ওপারে ছড়িয়ে দিয়ে ওপর থেকে জল ছিটিয়ে মাটি টা 7 দিন রেখে দেবেন। গাছ লাগানোর আগে ওই মাটি পুনরায় একবার মিশিয়ে নেবেন।
গাছে সার প্রয়োগ:-
গাছের বৃদ্ধিকে তরান্বিত করতে ও গাছ থেকে প্রচুর ফুল পেতে নির্দিষ্ট সময়ে গাছে সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর পর নতুন শিকড় গজানো শুরু হলে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।টবে গাছ বসানোর ১ মাসের মধ্য কোন রাসায়নিক সার ব্যাবহার করবেন না, গাছ লাগানোর 15,20 দিন পর থেকে মাসে দুইবার করে 5 লিটার জলে 250 গ্রাম সরিষার খোল 3 থেকে 5 দিনের জন্য ভিজিয়ে রাখতে হবে, 5 দিন পর উপরের পাতলা হলুদ জল ২ লিটার জলে ১ লিটার মিশিয়ে নিতে হবে, এবং সন্ধাতে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এক লিটার জলে দুই গ্রাম Epsome সল্ট মিশিয়ে প্রত্যক 30 দিন অন্তর একবার মাটিতে দেবেন। আর কোনো রাসায়নিক সার এর প্রয়জোন হবে না। কিছু মাস পর অল্প জৈব সার দিলে ভালো হয়। জৈব সারের মধ্য কলার খোসা, ডিমের খোসা, হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি , পাতাপচা সার প্রভৃতি ব্যাবহার করা যেতে পারে । জৈব সারের পরবর্তে NPK (10:26:26) প্রতি 15 দিন অন্তর টবের সাইড দিয়ে প্রয়াগ করতে হবে। রাসায়নিক সার ব্যাবহারের 15- 20 দিন পর যে কোন কম্পোস্ট সার মাটিতে দেওয়া যেতে পারে। মাটিতে রাসায়নিক সার ব্যাবহার করুন বা জৈব সার ব্যাবহার করুন প্রতি মাসে একবার করে অনুখাদ্য ব্যাবহার করতে হবে। অনুখাদ্য বা Micronutrients কি তা জানতে CLICK করুন: অনুখাদ্য কি?। তবে মনে রাখবেন, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার গাছের জন্য বিপদজনক।
জল প্রয়োগ:-
শীতকালে জারবেরা গাছে যে কোন সময়ে জল দেওয়া যেতে পারে কিন্তু গরমকালে ভুল করেও দুপুর বেলায় জল দেবেন না, গরমে সকাল ৪টার মধ্য জল দেওয়ার চেষ্টা করবেন। শীতকালে গাছে খুব বেশি জলের প্রায়াজন হয় না, তবে গরমকালে টবের মাটি বেশি শুঁকিয়ে গেলে দু বেলা জল দিতে হবে। বর্ষাকালে টব গুলিকে কাত করেও রেখে দিতে পারেন অথবা সেডের নিচে রেখে.দিতেপারেন । বৃষ্টির কিছুদিন পর টবের মাটি একটু খুঁড়ে দেবেন ও গাছটিকে রৌদ্রে রেখে দেবেন। বর্ষাকালের টবের গাছগুলোতে 10 থেকে 12 দিন অন্তর অন্তর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
সূর্যের আলো:-
শীতকালে টবের জারবেরা গাছগুলিকে সম্পূর্ণ সূর্যের আলোতে রাখতে হবে এবং গরমকালে টপ গুলিতে সকালের সূর্যের আলো পায় এবং বিকালে সূর্যের আলো পায় এমন স্থানে রাখবেন দুপুরের রোদ যেন সরাসরি না পায় তেমন স্থানে রাখবেন |
[আরও পড়ুন: শীতকালীন ফুলের নাম ও ছবি ২১টি বিদেশী ফুল]
রোগ ও পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা
মুল পচা রোগ:-
- গাছে বেশি জল দেওয়ার ফলে অথবা মাটি বাহিত এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে মুলে পচন রোগ দেখা যায়। এরোগে আক্রান্ত হলে গাছের বৃদ্ধি থমকে যায় ,গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং অবশেষে সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে মাড়া যায়। তাই চারাগাছ প্রতিস্থাপনের পূর্বে মাটি জীবাণুমুক্ত করে চারা লাগালে এরোগ কম হয়।
গোড়া পঁচা রোগ:-
- জারবেরা গাছের গোড়া পঁচা রোগ অনেকটা মূল পঁচা এর ন্যায়, মাটি বাহিত রোগ। এ রোগের ফলে গাছের কেন্দ্রীয় অংশ প্রথমে কালো রং ধারণ করে এবং পরবর্তীতে গাছ পচে যায়।
প্রতিকার:-
- রিডোমিল অথবা ডায়থেন এম-45 ছত্রাকনাশক 0.2% হারে 7-10 দিন অন্তর স্প্রে করলে ভাল সুফল পাওয়া যায়।
- টপসিন 0.05% হারে 7-10 দিন অন্তর স্প্রে করেও এরোগ দমন করা সম্ভব।
[আরও পড়ুন: Azalea-এজেলিয়া ফুল গাছের যত্নের জন্য একটি ব্যাপক নির্দেশিকা]
শীতের সুন্দর ফুলের মধ্য জারবেরা অন্যতম হলেও এটি গন্ধহীন কিন্তু শীতের এমন অনেক সুন্দর ফুল আছে যা গন্ধহীন হলেও যার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই , জানতে দেখুন:- কিছু শীতের ফুলগাছ
প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কাম্য করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।
আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।
FAQ [Frequently Asked Questions]
জারবেরা ফুল কখন ফোটে?
প্রায় সারা বছরই দু- একটি ফুল ফুটলেও মার্চ থেকে মে মাসে অধিক ফুল ফোটে। জারবেরা সব ধরনের জলবায়ু এবং মাটিতে জন্মাতে সক্ষম।
জারবেরা গাছের জন্য কেমন যত্নের প্রয়োজন?
জারবেরা ফুলের উজ্জ্বল এবং সুন্দর রঙের জন্য শীতের মরসুমে প্রায় সমস্ত বাগানী এই গাছগুলি টবে বা মাটিতে প্রতিস্থাপন করে থাকে। জারবেরা চাষের জন্য দ্রুত জল নিষ্কাশনযোগ্য হালকা উর্বর দোঁয়াশ বা বেলে দোঁয়াশ মাটি উত্তম। উজ্জ্বল সূর্যালোক এবং মাঝারি তাপমাত্রার সহ প্রচুর জৈব সার সমৃদ্ধ মাটিতে জারবেরা চাষ করলে অধিক ফুল পাওয়া যায়।
জারবেরার গাছে কি প্রচুর জলের প্রয়োজন?
শীতের মরসুমে জারবেরার গাছে বিশেষ জলের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু
বসন্ত এবং গ্রীষ্মের সময়ে মাটি পরীক্ষা করে জারবেরা গাছে গভীরভাবে ভিজিয়ে দিন। শরৎ এবং শীতকালে, মাটির উপরের 5 সেন্টিমিটার শুকিয়ে গেলে তবেই জল দেওয়া প্রয়োজন। বর্ষাকালে টবের গাছ এবং মাটিতে থাকা গুলিকে সেডের নীচে রাখবার ব্যাবস্থা করতে হবে।