Last updated on November 17th, 2023 at 08:31 pm
স্ট্রবেরি মূলত শীতকালীন ফল, কয়েক বছর আগেও স্ট্রবেরি বিদেশ থেকে আমদানী করা হতো তবে বর্তমানে ভারতবর্ষ,বাংলাদেশে, এবং প্রতেবেশী দেশেও প্রচণ্ড ঠান্ডায় স্ট্রবেরি চাষ ভালো হচ্ছে। স্ট্রবেরি একটি দামি, সুস্বাদু ও লোভনীয় ফল তাই বাড়িতে সামান্য জায়গা থাকলেই ছাদ বাগানে স্ট্রবেরি চাষ খুব সহজেই করতে পারেন । চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে নভেম্বর এই দুই মাস। যাদের বড় জায়গা বা বাগান আছে তারা খুব সহজেই এই স্ট্রবেরি চাষ করতে পারেন কিন্তু যাদের ছাদে বা বারান্দায় সামান্য জায়গা আছে তারা সেই ছোট্ট পরিসরেও স্ট্রবেরি চাষ করতে পারেন।
তবে জানুয়ারী মাসে স্ট্রবেরি চারা লাগালে এপ্রিল মাসে স্ট্রবেরি ফলানো যাবে। আর এই গাছ গুলোকে বিশেষ যত্ন এবং পরিচর্যা করলে পরবর্তী সিজনে আর চারা গাছ কেনার প্রয়োজন হবে না। এই পোস্টে স্ট্রবেরি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম।
স্ট্রবেরি ফলে প্রতি ১০০ গ্রামে যে পুষ্টি উপাদান গুলো থাকে। | |
---|---|
জল | ৯১.৬৭ মিলিলিটার |
খাদ্যশক্তি | ৩০ কিলোক্যালরি |
আমিষ | ০.৬১ গ্রাম |
শর্করা | ৭.০১ গ্রাম |
খাদ্যশক্তি | ৩৫-৫০ কিলোক্যালরি |
চর্বি | ০.৩৭ গ্রাম |
অশোধিত আঁশ | ২.২৯ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ১৩.৮৯ |
লৌহ | ০.৩৮ |
ম্যাগনেসিয়াম | ৯.৭২ |
পটাসিয়াম | ১৬৭.০০ |
ভিটামিন এ | ২৭.০০ |
নিয়াসিন | ০.২৩ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন সি | ৫৭.০০ |
ফসফরাস | ১৮.৭৫ |
ছাদ বাগানে স্ট্রবেরি চাষ প্রদ্ধতি এবং রোগ-বালাই ও পরিচর্যা
স্ট্রবেরি চাষের জন্য স্থান নির্বাচন:
যে কোন গাছের জন্য রোদ একটি অপরিহার্য উপাদান। তবে সারাদিন সরাসরি সূর্যের আলো থেকে গাছ দূরে রাখা ভালো, বিশেষ করে গরমের সময়ে। সকালের হালকা সূর্যের আলো আর শেষ বিকেলের মৃদু রৌদ্র গাছের জন্য বিশেষ উপকারী। আবার খেয়াল রাখতে হবে স্ট্রবেরি গাছের উপর রাতের শিশির যেন পড়ে। মোট কথা গাছের সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত রোদ এবং শিশির দুটোই প্রয়োজন। উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং জলনিকাশের সুবিধাযুক্ত বেলে-দোআঁশ মাটি স্ট্রবেরি চাষের জন্য একদম আদর্শ।
স্ট্রবেরি চাষের জন্য চারা নির্বাচন:
নার্সারী থেকে উন্ন্যত জাতের চারা সংগ্রহ করতে হবে। চারা লাগানোর কিছু দিনের মধ্যেই রানারের মাধ্যমে নতুন করে আরও কিছু চারা জন্মাতে থাকে, যা থেকে নতুন চারা গাছের সংখ্যা বাড়ানো যায়।
স্ট্রবেরি জাত নির্বাচন:
বর্তমানে উন্নত কৃষি গবেষণায় স্ট্রবেরির উন্নত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। নিম্নে প্রধান তিন ধরনের স্ট্রবেরি রয়েছে: জুন-বেয়ারিং, এভারবিয়ারিং এবং ডে-নিউট্রাল। জাতগুলোর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো।
- জুন-বিয়ারিং স্ট্রবেরি: এই জাতগুলি প্রতি বছর একক, বড় ফসল উৎপাদন করে, সাধারণত জুন মাসে। যারা তাজা ফল সংরক্ষণ বা উপভোগের জন্য ঘনীভূত ফসল চান তাদের জন্য জুন-বিয়ারিং স্ট্রবেরি আদর্শ।
- এভারবিয়ারিং স্ট্রবেরি: এই গাছগুলি ক্রমবর্ধমান ঋতু জুড়ে দুই থেকে তিন বার ফসল উৎপাদন করে—আরও বর্ধিত স্ট্রবেরি উপভোগের সময়ের জন্য আদর্শ।
- ডে-নিউট্রাল স্ট্রবেরি: এগুলি অন্যদের থেকে ভিন্ন, দিন-নিরপেক্ষ জাতগুলি দিনের দৈর্ঘ্য নির্বিশেষে সারা মৌসুমে ধারাবাহিকভাবে ফল দেয়। যারা স্ট্রবেরি স্থিরভাবে সরবরাহ করতে চান তাদের জন্য উপযুক্ত।
[আরও পড়ুন: কিউই ফল গাছের প্রতিস্থাপন এবং সম্পূর্ন পরিচর্যা | How to grow & care kiwi fruit plant]
স্ট্রবেরি চাষ প্রদ্ধতি:
স্ট্রবেরি জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত মাটিতে ভাল বৃদ্ধি পায়। স্ট্রবেরি চাষের জন্য একটি রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান নির্বাচন করতে হবে, কারণ এই গাছগুলিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা সূর্যালোকের প্রয়োজন হয়। রোপণের আগে, উর্বরতা এবং নিষ্কাশন উন্নত করতে কম্পোস্ট দিয়ে মাটি সংশোধন প্রয়োজন।
স্ট্রবেরি বেডে অথবা সমতল স্থান পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। তবে ফাটিগেশন পদ্ধতিতে চাষ করার জন্য বেড পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এজন্য ২- ১৮ ইঞ্চি ব্যবধানে (২-৩ ফুট ব্যবধানে) সারি এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুইটি বেডের মাঝে ৩০-৫০ সেন্টিমিটার নালা প্রস্তুত করতে হবে। প্রতি বেডে ৩০-৫০ সেন্টিমিটার দূরত্বে দুই সারিতে ২০-৪০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে। আগাম রোপণের জন্য পাতলা এবং নাবি রোপণের জন্য ঘন করে চারা লাগাতে হবে।
স্ট্রবেরির গাছের পরিচর্যা :
অন্যান্য ফল গাছের মতোই স্ট্রবেরির গাছের কিছু পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। আগাছা পরিষ্কার, মরা পাতা কেটে ফেলে দেওয়া, মাঝে মাঝে মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হয় বায়ু চলাচলের জন্য। প্রতিদিন অল্প করে জল দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেনো জল জমে না থাকে।
গাছে ফুল আসার পরে স্ট্রবেরির গাছের বাড়তি পরিচর্যার প্রয়োজন। গাছে ফল ধরার পর খেয়াল রাখতে হবে ফল যেনো মাটি স্পর্শ না করে। ফল মাটি স্পর্শ করলে পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও পাখির আক্রমণ থেকে ফলকে সাবধানে রাখার জন্য, ফুল আসার পর পরই গাছ নেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
আর স্ট্রবেরি চাষে তেমন সার এর প্রয়োজন হয় না। তবে পনেরো/বিশদিন অন্তর অন্তর সামান্য পরিমাণ জৈব সার টবের চারপাশের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া ভালো (গাছের গোড়ায় দেয়া যাবে না, আর সার দেবার পর অবশ্যই জল দিতে হবে)। পোকা- মাকড় থেকে ফল গুলিকে রক্ষা করবার জন্য জৈব কীটনাশক ব্যাবহার প্রয়োজন।
মালচিং: আগাছা দমন করতে, আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং ফলগুলিকে মাটি স্পর্শ করতে বাধা দিতে গাছের চারপাশে খড় বা মালচের একটি স্তর প্রয়োগ প্রয়োজন।
ফিডিং: প্যাকেজ নির্দেশাবলী অনুযায়ী একটি সুষম, সর্ব-উদ্দেশ্য জৈব সার দিয়ে স্ট্রবেরি গাছ চাষ করা প্রয়োজন। বসন্তে স্ট্রবেরির গাছের কিছু পরিচর্যার প্রয়োজন, কারণ এই সময়ে গাছপালা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
রানার: স্ট্রবেরি গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে তারা রানার তৈরি করে। ফল উৎপাদনে শক্তিকে উৎসাহিত করতে এবং গাছগুলিকে হালকা করতে ছাঁটাই প্রয়োজন।
[আরও পড়ুন: ড্রাগন ফল গাছের সম্পূর্ণ চাষ পদ্ধতি]
স্ট্রবেরি গাছের রোগ-বালাই ও পরিচর্যা:
পাতায় বাদামি দাগ: অধিকাংশ সময়ে স্ট্রবেরি গাছের পাতায় বাদামি রংয়ের দাগ পরিলক্ষিত হয়। এ রোগের আক্রমণ হলে ফলন এবং ফলের গুণগত মান হ্রাস পায়। প্রতিকার পেতে যে কোন ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার জলের সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
ফল পচা রোগ: এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে ভেজা বাদামি বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। প্রতিকার পেতে ফল পরিপক্ব হওয়ার পূর্বে নোইন ৫০ ডব্লিওপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার জলের সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ক্রাউন রট: এ রোগে আক্রান্ত হলে গাছের কচি পাতা বিবর্ণ হয়ে ঢলে পড়ে যার যা দ্রুত সমগ্র গাছে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ বাদামি বর্ণ ধারণ করে মারা যায়। Phytophthora নামক ছত্রাকের আক্রমণে স্ট্রবেরি গাছে ক্রাউন রট রোগ হয়। আক্রান্ত ক্রাউন মাঝ বরাবর লম্বালম্বি ব্যবচ্ছেদ করলে কাণ্ডের মাঝ বরাবর বাদামি বা হালকা গোলাপি বর্ণ ধারণ করে।
জলাবদ্ধতা সম্পন্ন মাটিতে ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। এর জন্য জমি শুষ্ক রাখতে হবে।
[আরও পড়ুন: টবে জামরুল গাছের পরিচর্যা এবং মাটি তৈরি]
প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।
আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।
কিভাবে স্ট্রবেরি চাষ করা হয়?
বংশবিস্তার: স্ট্রবেরি চাষ রানার দ্বারা প্রচার করা হয়। সাধারণত একটি উদ্ভিদ 7 – 10 রানার তৈরী করে তবে সঠিক ব্যবস্থাপনায় প্রতি গাছে 15 টি প্রযন্ত রানার পাওয়া যেতে পারে। স্ট্রবেরি চাষের জন্য সমতল অথবা ঢালু স্থান নির্বাচন করতে হবে, যেখানে সহজে জল না দাঁড়াতে পারে। স্ট্রবেরি চাষের জন্য,উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং জলনিকাশের সুবিধাযুক্ত বেলে-দোআঁশ মাটি আদর্শ।
স্ট্রবেরি চাষের জন্য কেমন সূর্যালোক প্রয়োজন?
স্ট্রবেরি গাছের বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ফল উৎপাদনের জন্য সূর্যের আলো প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন ৮ বা ততোধিক ঘন্টা সূর্যালোক আদর্শ, তবে তাদের প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় ঘন্টা সরাসরি সূর্যালোক প্রয়োজন। স্ট্রবেরি চাষের জন্য,উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং জলনিকাশের সুবিধাযুক্ত বেলে-দোআঁশ মাটিতে স্ট্রবেরি চারা রোপন করতে হবে।