টবে ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা | How to Grow and Care for Dahlias

Last updated on November 23rd, 2023 at 01:34 pm

টবে ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা করবার জন্য স্থান নির্বাচন, মাটি প্রস্তুত এবং সার প্রয়োগের যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। শীতের মরসুমের জনপ্রিয় ফুলের মধ্য রয়েছে ডালিয়া। ডালিয়া আমাদের সকলের পরিচিত ফুল। ডালিয়ার আদি বাসস্থান আমেরিকার মেক্সিকো শহর। সর্ববৃহৎ আকার ও আকর্ষণীয় রঙের কারণে ডালিয়া শীতের ফুলের মধ্যে অন্যতম। দৃষ্টিনন্দন পাপড়ির বিন্যাস ও বর্ণ বৈচিত্র্যের জন্য এটি সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কোনোটা এক রঙ আবার কোনোটায় একাধিক রঙের মিশ্রণ। ডালিয়া মূলত আকারে বড় হলেও ছোট সাইজের ডালিয়াও পাওয়া যায়। ডালিয়ার চারাগাছ প্রতিস্থাপনের আদর্শ সময় নভেম্বর মাস।

ডালিয়ার এক ধরনের গুল্মজাতীয়, কন্দযুক্ত, সপুষ্পক ভেষজ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ,যার বৈজ্ঞানিক নাম Dahlia Variailis। ডালিয়া কম্পোজিটি পরিবারভুক্ত। এ ফুলের আদি বাসস্থান মেক্সিকোর গুয়াতেমালায়। মৌসুমী ফুলের মধ্যে ডালিয়া সর্ববৃহৎ আকার ও আকর্ষণীয় রঙের ফুল। ডালিয়ার ৪২টি প্রজাতি রয়েছে, সাধারণত সংকর প্রজাতিগুলি বাগানের গাছ হিসাবে দেখা যায়। লর্ডবুটি নামের এক ব্যক্তি স্পেন থেকে ডালিয়া ফুল প্রথমে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। সেই ফুল দেখে সুইডেনের উদ্ভিদতত্ত্ববিদ আন্দ্রিয়াস গুস্তাভ ডাল নিজের নামের অনুকরণে ফুলের নাম রাখেন ডালিয়া।

টবে ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা | How to Grow and Care for Dahlias

ডালিয়া ফুল বিভিন্ন আকার ও বর্ণের হয় যেমন: লাল, সাদা, কমলা, বেগুনি, হলুদসহ বিভিন্ন রঙের হয় শুধু সবুজ আর নীল রঙ ছাড়া। এই ফুলের উল্লেখযোগ্য কিছু জাত হচ্ছে স্টার ডালিয়া, সিংগেল ডালিয়া, কলারেট ডালিয়া, ডেকোরেটিভ ডালিয়া, স্টারলেট কুইন, অ্যানেমনি ডালিয়া, হোয়াইট ষ্টার, ক্যাকটাস ডালিয়া, ইত্যাদি। ডালিয়া ফুল আপনি আপনার ফ্ল্যাটের বারান্দায় বা ছাদে অল্প স্থানে পরিচর্যা করতে পারেন। এই ফুল খুব অল্প সময়ে এমন কি মাত্র মাস খানেক সময়ের মধ্যে ফোটানো সম্ভব। নার্সারি থেকে ভালো জাতের চারা এনে টবে রোপন করে সঠিক যত্ন নিলে মাস খানেক মধ্য ফুল ফুটতে শুরু করবে ।

ডালিয়া ফুল গাছের স্থান নির্বাচন:

পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন স্থান ডালিয়া ফুলের চাষাবাদের জন্য আদর্শ। কারণ ছায়াযুক্ত স্থানে গাছ দুর্বল ও লম্বা হয়, ফুলের আকার ছোট হয়, গাছে ফুল কম হয় এবং রঙের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস পায়। ডালিয়া চাষের জন্য সারাদিন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা অধিকাংশ সময় রোদ পায় এরকম জায়গাতেই ডালিয়ার চাষ উত্তম। ডালিয়া রোপণের জন্য লম্বা সারি তৈরী করে এক ফুঁট দূরত্ব রেখে চারা গাছ প্রতিস্থাপন করতে হবে।

ডালিয়ার চারা গাছ সংগ্রহ:-

চারা গাছ সংগ্রহের সময় আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে ভালো ও সুস্থ সবল চারা নির্বাচনের জন্য। যেকোনো নার্সারি থেকে আপনি চারা সংগ্রহ করতে পারেন, স্বল্প টাকার বিনিময়ে আপনি উন্ন্যত মানের ভালো চারা পেয়ে যাবেন। ডালিয়ার চারা নভেম্বর – ডিসেম্বর মাসে প্রতিস্থাপন করতে হয়।

ডালিয়া ফুল গাছের মাটি প্রস্তুত এবং প্রতিস্থাপন পদ্ধতি:

ডালিয়া প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থ সহ সমৃদ্ধ, দোআঁশ মাটি পছন্দ করে যা ভালভাবে নিষ্কাশন করে। বাড়ির উঠোনে ডালিয়ার চাষ করতে মাটির সাথে পর্যাপ্ত পারিমানে জৈবসার,হাঁড়গুড়ো,শিংকুঁচি,নিমখোল,পিট মস প্রভৃতি যোগ করে হালকা জল ছিটিয়ে ১০ দিনের জন্য রেখে দিতে হবে। ১০ থেকে ১২ দিন পর মাটি আলগা করে দিতে হবে। ডালিয়াস একটি নিরপেক্ষ মাটির pH প্রায় 6.5.তে বৃদ্ধি পায়।

টবে ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা

ডালিয়ার বালুকাময় দোঁয়াশ মাটি পছন্দ করে, ঘন, ভেজা কাদামাটি মাটি বা এঁটেল মাটি একেবারেই পছন্দ করে না অর্থাৎ গাছের জন্য এমন মাটি তৈরি করতে হবে যাতে আর্দ্রতাও থাকবে অথচ মাটিতে জল ও দাঁড়াবে না, মাটি বেশি মাত্রায় আর্দ্র থাকলে গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই এর জন‍্য দরকার একভাগ গার্ডেন সয়েল(দোঁয়াশ মাটি),দুভাগ নদীর সাদা বালি ( বেলে-দোঁয়াশ মাটি ব্যাবহার করলে বালির প্রয়োজন নেই )ও একভাগ ভার্মিকম্পোস্ট বা এক বছরের পুরোনো পাতা পচা সার বা পচানো গোবর সার এর সাথে আট ইঞ্চি টবের জন‍্য হাঁফমুঠো শিংকুঁচি, হাঁফমুঠো হাঁড়গুড়ো, হাফমুঠো নিমখোল মিশিয়ে নিতে হবে। এই ভাবে উন্ন্যত মানের হালকা উর্বর মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে।

টবে চারা গাছ প্রতিস্থাপন করতে চাইলে, আগে থেকে মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে একভাগ দোঁয়াশ মাটি, দুভাগ নদীর সাদা বালি (বেলে-দোঁয়াশ মাটি ব্যাবহার করলে বালির প্রয়োজন নেই )ও একভাগ গোবর সার বা ভার্মিকম্পোস্ট বা এক বছরের পুরোনো পাতা পচা সার এর সাথে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি টবের জন‍্য হাঁফমুঠো শিংকুঁচি, হাঁফমুঠো হাঁড়গুড়ো, রক্তসার, হাফমুঠো নিমখোল মিশিয়ে নিতে হবে। এবার হালকা জল ছিটিয়ে পালিথিন দিয়ে ১০ দিনের জন্য ডেকে রেখে দিতে হবে। ১০ থেকে ১২ দিন পর পালিথিন আলগা করে মাটি এক, দুই দিনের জন্য শুকোতে দিতে হবে। এই ভাবে আপনি ডালিয়া গাছের জন্য আদর্শ মাটি প্রস্তুত করে নিতে পারবেন।

ডালিয়া ফুল চাষের জন্য টব নির্বাচন:

ডালিয়া ফুল ছাদে অথবা টবে করার জন্য আপনি মাঝারি সাইজের টব (১০ থেকে ১২ ইঞ্চি) অথবা হাফ ড্রাম সংগ্রহ করতে পারেন। এছাড়াও বাড়ির আঙ্গিনায় বা বাগানে চাষ করার জন্য স্বল্প পরিসরে আপনি এই ডালিয়া ফুলের চাষ করতে পারেন।

ডালিয়ার চারা রোপনের পূর্বে টব বা উপযুক্ত জায়গার মাটিকে অবশ্যই ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। ডালিয়ার চারা মূলত তিন ভাবে করা হয়ে থাকে। একটি হল বীজ পদ্ধতি, দ্বিতীয় কন্দ প্রতিস্থাপন পদ্ধতি এবং অপরটি হল কলম পদ্ধতি। তবে বীজ থেকে তৈরি গাছের মাতৃগুনাগুন বজায় থাকে না, সুতরাং সকলেই কলম পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন, যার ফলে গাছের মাতৃগুনাগুন বজায় থাকে। ডালিয়ার চারা লাগানোর পূর্বে মাটিতে গোবর/কম্পোষ্ট, কাঠের ছাই, হাড়ের গুঁড়ো,শিংকুঁচি ভালো ভাবে মিশাতে হবে। চারা লাগানোর পরে গাছে নিয়মিত জল দিতে হবে।

[আরও পড়ুন: ক্লার্কিয়া ফুল গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা | Easy To Grow Clarkia Flower Plants]

ডালিয়া গাছের জন্য জলের ব্যবস্থাপনা:

এই গাছে মোটামুটি নিয়মিত জল দিতে হবে। তবে অবশ‍্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনভাবেই গাছের গোড়ায় জল না জমে। গাছের গোড়ায় জল জমলে গাছ মারা যেতে পারে। তাই জল দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বণ করা প্রয়োজন।

ডালিয়া ফুল গাছে সার প্রয়োগ:

ডালিয়ার চারা টবে প্রতিস্থাপন করতে চাইলে প্রথমে ৬ ইঞ্চি টবে, পরবর্তী সময়ে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি টবে চুড়ান্ত প্রতিস্থাপন করতে হবে। মাটির সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব সার থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। ফুলের উজ্জ্বলতা এবং গাছের রোগপ্রতিরোধ বৃদ্ধি করতে ফসফেট ও পটাশ সার ব্যবহার করতে হবে তবে, সেটি বড় পাত্রে চুড়ান্ত প্রতিস্থাপনের পড়ে।

টবে ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা

ডালিয়ার চারা গাছে গুলি যখন ৬ ইঞ্চি পাত্রে থাকবে তখন ৫ লিটার জলে ২৫০ গ্রাম সরিষার খোল ৫ দিনের জন্য ভিজিয়ে রাখতে হবে, ৫ দিন পর উপরের পাতলা হলুদ ২ লিটার জলে ১ লিটার সাধারণ জল মিশিয়ে নিতে হবে, গাছের গোড়ায় খোল জল দেওয়ার আগের দিন ৬ ইঞ্চি পাত্রের জন্য ৪ থেকে ৫ টি DAP/TSP দানা অল্প জলে ভিজিয়ে রাখবেন এবং গাছের গোড়ায় খোল জল দেওয়ার দিন তাতে মিশিয়ে নেবেন। তার পরে গাছের গোড়ায় দিতে হবে।

গাছের বয়স এক মাস হয়ে গেলে প্রতি টবে ১০ গ্রাম টিএসপি/ ডিএপি, ১০ গ্রাম এমওপি ও ১০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে ( প্রতিবারে ৮ থেকে ১০টি দানা)। কুঁড়ি উৎপাদনের পূর্বে এক লিটার জলে দুই গ্রাম Epsome সল্ট মিশিয়ে প্রত্যক ৩০ দিন অন্তর গাছে স্প্রে করবেন তাতে কুঁড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আর কোনো রাসায়নিক সার এর প্রয়জোন হবে না। কুঁড়ি উৎপাদনের পূর্বে প্রতি ১০ দিন বা দুই সপ্তাহে একদিন NPK (10:26:26) সার দিন। সার দেওয়ার পরে, সার দ্রবীভূত করতে গাছকে জল দিন। প্রতি মাসে একবার গাছে সুষম সার দিন। বিকল্পভাবে, আপনি জৈব সার যেমন ভার্মিকম্পোস্ট বা গোবরসার অথবা পাতা পচা সারের সাথে অনুখাদ্য বা Micronutrients :Top Gold, Agromin Gold, Agromin Max ব্যাবহার করতে পারেন। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।

ডালিয়া ফুল গাছের পরিচর্যা:

ডালিয়া গাছের কুড়ি আসার পর নিয়মিত জল অল্প পরিমানে ঘন ঘন দিতে হয়। গাছের গোড়ার মাটি ঝুরঝুরে ও আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। তবে চারা ছোট থাকা অবস্থায় সপ্তাহে একবার এবং সেচ দেয়ার আগে মাটি আলগা ও আগাছা পরিস্কার করে নিবেন।

ডালিয়ার পরিচর্যা হিসেবে একটু সচেষ্ট ও যত্নবান হতে হয়। ভাল ফুল পেতে হলে সাধারণ ভাবে গাছ গুলোর কেবল মাঝারে বড় কুঁড়িটিকেই রেখে বাকি সব কুঁড়ি ভেঙ্গে দিতে হয়। প¤পন ডালিয়ার বেলায় কুঁড়ি ভাঙ্গার কোনও প্রয়োজন নেই। বেশি ফুটানোর বেলায় ফুল ফুটার মাঝের সময় কুঁড়ি ভেঙ্গে দিতে হয়। গাছ যখন ২৫ সেঃমি বড় হবে তখন গাছটির মাথা নখ দিয়ে খুঁটে দেওয়া ভাল। এভাবে করলেই ডাল ছাড়তে আরম্ভ করবে। তখন মাত্র ৪টি ভালো ডাল রেখে বাকিগুলো ছেঁটে দিতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে ৪টি ডাল থেকে ৪টি ফুল হবে। ফুল তুলে নেবার পর এ চারটি ভাল ডালের নিচের থেকে গজালে আরও চারটে ডাল বেরোবে এবং যথাসময়ে একই ভাবে ফুল ফুটবে। আর সার প্রয়োগ করতে হবে প্রথম বারের ফুল তোলার পরই।

পোকামাকড় দমন:

ডালিয়ার গাছে জাব পোকা, থ্রিপস ও মাকড়ের আক্রমনে বেশি ক্ষতি করে থাকে। জাব পোকা ও থ্রিপস ডালিয়া গাছের পাতা, কুঁড়ি ও ফুলের রস শোষণ করে গাছ নষ্ট করে দেয়। জাব পোকা ও থ্রিপস দমনের জন্য মাত্রা অনুযায় রাসায়নিক কীটনাশক জলের সাথে মিশিয়ে সন্ধ্যার সময় স্প্রে করতে হবে।

[আরও পড়ুন: নন্দিনী ফুল গাছের প্রতিস্থাপন ও সম্পূর্ন পরিচর্যা | Easy to Grow and Care Nandini Flower Plant]

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *