মিষ্টি কুমড়ো চাষের সময়, বীজবপন ও সার প্রয়োগ প্রদ্ধতি

মিষ্টি কুমড়ো এক প্রকার বার্ষিক ফসল যা আরোহী লতা জাতীয় হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Cucurbita moschata এবং ইংরেজি নাম Sweet pumkin। ছোট অবস্থাতে মিষ্টি কুমড়ো দেখতে সাধারণত গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়, পাঁকলে তা হলুদ বর্ণ ধারণ করে ৷ কুমড়ো আমরা কম বেশি সারা বছরই দেখতে পাই । মিষ্টি কুমড়ো পুষ্টিকর একটি ফসল এটি শরীরের জন্য ভীষণ উপকারী । মিষ্টি কুমড়োর পাতা ও কচি ডগা শাক হিসেবে বিক্রয় হয় ।

মিষ্টি কুমড়া চাষের আদর্শ সময় কখন, কি ভাবে যত্ন নিলে জমিতে প্রচুর কুমড়ো ফলানো সম্ভব? কি সার প্রয়োগ করবেন? কোন সময়ে ছত্রাক নাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে? সবকিছু জানবেন আজকের প্রতিবেদন থেকে।

মিষ্টি কুমড়ো চাষের সময়, বীজবপন ও সার প্রয়োগ প্রদ্ধতি

আজকের প্রতিবেদন থেকে আপনি মিষ্টি কুমড়ো চাষ প্রদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন

মিষ্টি কুমড়ো চাষের সময়:

মিষ্টি কুমড়া চাষের সময় এবং চাষ প্রদ্ধতি নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদন, মিষ্টি কুমড়া চাষের সঠিক সময় কখন তা জেনে নিন এবং পুরো প্রতিবেদন টি পড়ে শেয়ার করে দিন যাতে সমস্ত কৃষি উদ্যোক্তা বন্ধুরা জানতে পারে মিষ্টি কুমড়া চাষের প্রদ্ধতি এবং সময়।

যেহেতু মিষ্টি কুমড়া বর্ষাতি ফসল, তাই শুরুতে এর বাজার দর খুব ভালো পাওয়া যায়। বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত কুমড়োর বীজ বসাতে পারেন। বর্ষাতি কুমড়ো চাষ করার জন্য, আপনারা হাইব্রিড বীজ অথবা দেশী বীজ বসাতে পারেন। ভরা বর্ষায় F1 হাইব্রিড বীজের ফলন তুলনামূলক একটু কম হয় এবং দেশী বীজে বেশ ভাল রকম ফলন পাওয়া যায়।

মিষ্টি কুমড়ো চাষের সময়

বীজ বপন ও চারা রোপণ:

মিষ্টি কুমড়ার বীজ সরাসরি জমিতে রোপণ করা যায় এছাড়া ও ছোট আকারের পলিথিন ব্যাগে চারা উৎপাদন করে তা জমিতে রোপণ করা যায়।

মিষ্টি কুমড়ার বীজ সরাসরি জমিতে রোপনের পূর্বে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে, মাটি তৈরি করার সময় বিঘা প্রতি জৈব সার হিসাবে এক বছরের পুরনো পচানো গোবর সার দুই ট্রাক্টর ব্যবহার করবেন। গোবর সার জমিতে ছিটিয়ে দেওয়ার পর ৩০ কেজি চুন দিয়ে আড়াআড়ি চাষ দিতে হবে।

চাষের পূর্বে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মাটিবাহিত রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করবার জন্য শেষ চাষের আগে ব্যাকটেরিয়া নাশক সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স এবং কার্বোমিন দানা দিয়ে চাষ দিতে হবে। জমি জো হলে বেড এবং নালা প্রস্তুত করতে হবে।

বেড চওড়া হবে মোটামুটি আড়াই থেকে তিন ফুট এবং মাদা থেকে মাদার দূরত্ব হবে ছ’ফুট এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে সাত ফুট। যেহেতু মিষ্টি কুমড়ো বর্ষাকাল প্রযন্ত হয়, তাই বেড একটু উঁচু করবেন, যাতে জল না দাঁড়ায়। জমি পুরো পুরী তৈরি হলে মাটির দুই ইঞ্চি গভীরে তিনটি থেকে চারটি বীজ প্রতিস্থাপন করতে হবে। সবশেষে সেচ দিতে হবে।

মিষ্টি কুমড়ো গাছের যত্ন:

আগাছা সরিয়ে চারা গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করতে হবে। কৃত্রিম পদ্ধতিতে পুরুষ ফুলের রেণু স্ত্রী ফুলের উপর ছড়িয়ে দিলে উৎপাদন বাড়বে। গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা বের হয়। এগুলোকে শোষক শাখা বলে। শোষক শাখা গাছের বৃদ্ধিতে বাধা দেয় ও ফলন কমিয়ে দেয়।

মিষ্টি কুমড়ো গাছে সার প্রয়োগ:

ভালো ফলন পেতে হলে মিষ্টি কুমড়া চাষের জন্য জমিতে যতটা সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। মাটি পরীক্ষা করে তার ধরন অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। পরিবেশ এবং মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সবসময় জৈব সার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

মিষ্টি কুমড়ো চাষের সময়
  • কুমড়ো গাছে যখন লতা ছাড়তে শুরু করবে, সেই সময় প্রথম চাপান সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।
  • জৈব সার হিসেবে বিঘা প্রতি ২৫-৩০ কেজি সর্ষের খোল এবং গোবর সার এবং রাসায়নিক সার হিসাবে ১৫-২০ কেজি NPK10:26:26 বা ১৪:৩৫:১৪ ব্যবহার করতে পারেন। ইউরিয়া সার প্রয়োগ করবার প্রয়োজন নেই।
  • রাসায়নিক সারের পাশাপাশি বিঘা প্রতি যে কোন কোম্পানির সামুদ্রিক শৈবাল ৩ কেজি হারে প্রয়োগ করবেন।
  • পাশাপাশি গাছে অণুখাদ্যর অভাব দূর করতে ও ভাল ফলন পেতে বিঘা প্রতি এক কেজি হারে অণুখাদ্য (micronutrients) ব্যবহার করবেন।

[ আরো দেখুন: লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা ]

আগাছা দমন:

জমিতে আগাছা বা জঙ্গল দেখা মাত্র তা দমন করতে হবে। আগাছা, গাছের বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এবং মাটি থেকে পুষ্টি শোষন করে নেই। তাই জমি সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

কুমড়ো গাছে সেচ ও নিষ্কাশন:

  • সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিয়ে জমি ভিজিয়ে দিতে হবে।
  • শীতকালীন চাষের জন্য এক মাস পর পর জমিতে সেচ দিতে হবে, এবং বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণ বুঝে।
  • মিষ্টি কুমড়া চাষের সময়ে জমিতে জল বেধে থাকলে তা বার করবার ব্যাবস্থা করতে হবে।

মিষ্টি কুমড়া কত দিনে ফল দেয়?

মিষ্টি কুমড়োর ফলন নির্ভর করে বীজের জাত, আবহাওয়া এবং চাষাবাদের পদ্ধতির ওপর। সাধারণত, মিষ্টি কুমড়োর বীজ বপণের প্রায় ৯০-১২০ দিন পর থেকে ফল দিতে শুরু করে। প্রচলিত জাতগুলোর মধ্যে ফ্যামিলি ফেভারিট এবং ব্যুশ ভারলেস্ট জাতগুলো ৮০-৯০ দিনের মধ্যে ফল দেয়। প্রোলিফিক বা ভিনি সীডলেস জাতগুলোর ফল পাওয়ার জন্য প্রায় ৯০-১০০ দিন লাগে।

যদি আবহাওয়া খুব গরম ও আর্দ্র থাকে তবে ফলন আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আবার ঠান্ডা আবহাওয়ায় ফলনের বৃদ্ধি থমকে যায়। যথাযথ জল সেচ, সার প্রয়োগ এবং রোগবালাই দমন করলে ফলনের বৃদ্ধি বেশি হয়।

জমি থেকে কুমড়ো তোলার সময়:

গাছের ডালপালা শুকিয়ে গেলে এবং ফলের ত্বক শক্ত ও হলুদ হয়ে গেলে কুমড়ো সংগ্রহ করতে হবে। রান্নায় ব্যবহার করার আগে কয়েক সপ্তাহের জন্য শীতল অথবা শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখুন। সঠিক যত্ন এবং মনোযোগ সহ, আপনি মিষ্টি, সুস্বাদু কুমড়ার প্রচুর ফসল উপভোগ করতে পারেন।

ছত্রাক নাশক প্রয়োগ:

  • কুমড়ো চাষের প্রথম সমস্যা গোড়া পচন রোগ, এক্ষেত্রে আপনি প্রথম থেকে
  • ROKO(Thiophanate Methyl ৭০% WP) প্রতি লিটার জলে দু’গ্রাম হারে সমস্ত গাছে স্প্রে করবেন।
  • অথবা, Bavistin, প্রতি লিটার জলে দুই থেকে আড়াই গ্রাম হারে মিশিয়ে সমস্ত গাছে স্প্রে করবেন।
  • অথবা, UPL কম্পানির SAAF(CARBENDAZIM ১২% + MANCOZEB 63% WP) প্রতি লিটার জলে দু’গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করেন।
  • অথবা, টাটার মাস্টার(Metalaxyl ৮% + Mancozeb ৬৪% WP) প্রতি লিটার জলে দু’গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করেন।

অতি বৃষ্টির সময়ে, ১০ দিন অন্তর Dithane M- ৪৫(ম্যানকোজেব ৭৫%), প্রতি লিটার জলে তিন গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করবেন।
অথবা, Bayer কোম্পানির Antracol, প্রতি লিটার জলে আড়াই থেকে তিন গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করবেন।

এছাড়াও প্রথম পর্যায়ে, কুমড়ো গাছের তলার পাতায় বা পুরনো পাতায় পাউডারি মিলডিউ সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধানে- Nagarjuna কোম্পানির INDEX(Myclobutanil 10% WP), প্রতি ১৫লিটার জলে ১২ গ্রাম এবং তার সাথে Dithane M- ৪৫(ম্যানকোজেব ৭৫%), প্রতি লিটার জলে তিন গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করবেন।

মিষ্টি কুমড়ো সংগ্রহ:

মিষ্টি কুমড়ো কচি অবস্থা থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ পাকা অবস্থাতাতেও খাওয়া যায়। কচি কুমড়োর বাজার চাহিদা অধিক থাকায় চাষীরা ছোট অবস্থা থেকেই ফসল কাটা শুরু করে। কুমড়া পরিপূর্ণ পাকলে সংগ্রহ করে অনেকদিন ঘরে রাখা যায়। কুমড়োর চারা রোপনের তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই ফলন পাওয়া যায়৷ কুমড়ো গাছের লতা শুঁকিয়ে গেলে এবং ফল হলদে ভাব এলে তবে তা সংগ্রহ করা যেতে পারে৷

কুমড়োর গুনাগুন:

  • মিষ্টি কুমড়ো সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
  • উচ্চ রক্তচাপ কমাতে মিষ্টি কুমড়ো সহয়তা করে।
  • মিষ্টি কুমড়ো ওজন কমাতে বেশ কার্যকর।
  • ত্বকের আর্দ্রতা ও উজ্জ্বলতা ঠিক রাখতে সহয়তা করে মিষ্টি কুমড়ো ।
  • মিষ্টি কুমড়ো নিয়মিত খেলে হৃদ রোগের প্রবণতা কমে।
  • মিষ্টি কুমড়ো ক্যান্সার প্রতিরোধে সহয়তা করে।
  • চোখের ভাল থাকার জন্য এই সব্জীটি খুব ভাল।
  • ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও মিষ্টি কুমড়ো যথেষ্ট কার্যকর।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য, অর্শ, পেট ফাঁপা প্রতিরোধে মিষ্টি কুমড়ো যথেস্ট কার্যকর।
  • মিষ্টি কুমড়ো হজম শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়।
  • মিষ্টি কুমড়ো গর্ভবতী মায়েদের রক্তস্বল্পতা রোধ করে। ফলে অকাল প্রসবের সম্ভাবনা কমে যায়।
  • বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করতেও মিষ্টি কুমড়া সাহায্য করে।
আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *