সরিষা চাষ পদ্ধতি | আধুনিক পদ্ধতিতে সরিষার ফলন বৃদ্ধির উপায়

বর্তমানে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের ভোজ্য তেলের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে সরিষার তেল থেকে এবং বাকিটা সূর্যমুখীর বীজ থেকে প্রস্তুত ভোজ্য তেল, এটিই আমাদের ভোজ্য তেলের প্রধান ফসল। বিভিন্ন জাতের সরিষা বীজে ৩৮-৪৪ শতাংশ তেল থাকে আর বাকিটা খৈল ২৫ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ আমিষ। সরিষার বীজের আবরণ খৈল গৃহপালিত পশুদের পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ব্যাবহাত হয়। আমাদের দেশে প্রতি হেক্টরে সরিষার ফলন হয় ৬০০- ৭২৫ কেজি। দেশের ভৌগলিক তারতম্য ভেদে ফলন বেশি ও কম হতে পারে। তবে প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষা চাষ। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন চাষাবাদ হচ্ছে শীতকালের জনপ্রিয় ভোজ্য তেল ফসল হল সরিষা। অপেক্ষাকৃত কম খরচ ও পরিশ্রমে দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। বেশ কিছু বছর যাবৎ ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির কারনে সরিষার চাষা বাড়ছে ।

তবে নিয়ম মেনে চাষাবাদের পাশাপাশি, রোগবালাই দমন ব্যবস্থা জানা থাকলে স্বল্প সময়ে সাফল্য আশা করা যায়। সরিষার ফলন বৃদ্ধির উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব :- আজকের প্রতিবেদন থেকে আপনারা জানতে পারবেন– আধুনিক পদ্ধতিতে সরিষার চাষ সম্পর্কে। কীভাবে সরিষা চাষ করলে, অধিক ফলন পাবেন। আরও জানবো- সরিষা চাষে নতুন কিছু প্রযুক্তি, যেমন- জাত নির্বাচন, উপযুক্ত জমি নির্বাচন, সরিষা চাষের উপযুক্ত সময়, বীজ বপনের পূর্বে করণীয়, বীজ বপন পদ্ধতি।

সরিষার জাত নির্বাচন:

যেহেতু সরিষা স্বল্প মেয়াদী ফলন সেক্ষেত্রে চাষে উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশী জাতের সরিষা চাষ না করে উন্নত উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করে ৩২-৩৮ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষে প্রধানত ৩ প্রকার (টরি, শ্বেত ও রাই) সরিষার চাষাবাদ হয়। এছাড়া বর্তমানে নেপাস সরিষার চাষাবাদও হচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে দেশের উত্তরাঞ্চলও দক্ষিণাঞ্চলে যথাক্রমে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষার বীজ বুনতে হয়।

বাণিজ্যিক অর্থে সারসন, টোরিয়া এবং তারামিরাকে সাধারনত রেপসিড (Rape Seed) এবং মাষ্টার্ড (Mustard) অর্থে প্রধানত রাহি (Rai) কে বোঝায়। তবে বাজারে রেপ এবং মাষ্টার্ড (Rape Seed & Mustard) বলতে সরিষা, টোরিয়া, রাই, তারামিয়া ইত্যাদি সমস্ত তৈলবীজগুলিকে মোটামুটিভাবে বুঝায়।

টোরিয়া (Toria): অগ্রনী (বি-৫৪):

শাখা প্রশাখাযুক্ত সরিষা গাছগুলি বেঁটে আকৃতির হয়। দানা ছোট এবং পুষ্ট, রঙ লালচে বাদামী। আশ্বিন মাস থেকে কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে বপন করা চলে। বীজ বপনের পর আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে ফসল তোলা যায়। বীজের মধ্যে তৈলের পরিমান ৪৪ শতাংশ। একর প্রতি গড় ফলন ৩৫০-৪০০ কেজি।

হলুদ সরিষা (Yellow Sarson): বিনয় (বি-৯):

সরিষা গাছগুলি মাঝারি ধরনের, লম্বাই প্রায় ৯০ সেমি হয়। প্রচুর শাখা প্রশাখা ছাড়ে, ফল বড়সড় ও লম্বা, দানার রঙ হলুদ, অপেক্ষাকৃত বড়, গোলাকৃতি। বীজ বপনের পর বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে তিন থেকে সারে তিন মাসে ঘরে তোলা যায়। জলদি বপনের উপযুক্ত, বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে আশ্বিনের শেষ এবং কার্তিকের প্রথম পক্ষকালে বপন করা যায়। দানার মধ্যে ৪৬ শতাংশ তৈল বিদ্যমান। একর প্রতি ফলন ৫০০-৬০০ কেজি।

রাইসরিষা (Mustard): বরুনা (টি-৫৯):

সরিষা গাছগুলি বেশ লম্বা হয়, প্রায় ১-১.৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু, শাখা-প্রশাখা প্রচুর ছাড়ে এবং কাণ্ড কাঠাল। শুটি মোটা, বড়সড় এবং অগ্রভাগ সূচালো আকৃতি ধারণ করে। বীজের আকার তুলনামূলকভাবে বড়, গোলাকৃতি, রঙ কালচে বাদামী। বীজ বপনের প্রকৃষ্ট সময় কার্ত্তিক মাস। বৃষ্টি নির্ভর চাষ করা সম্ভব, তবে প্রয়োজনে সেচ দিলে ফলন বাড়ে। তৈলের পরিমান ৪৩.৫ শতাংশ। একর প্রতি ফলন ৮০০-১০০০ কেজি। ফল থেকে দানা সহজে ঝরে পড়ে না। ঠিক মত যত্ন পরিচর্যা করা হলে একর প্রতি ১৬০০ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব।

বপনের সময়:

ভালো ফলন পেতে হলে, অবশ্যই আপনাকে উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করতে হবে, তবে বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুযায়ী টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস পর্যন্ত বোনা যায়। রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বরর) মাস পর্যন্ত বপন করলে ভালো ফলন পাবেন।

উঁচু ও মাঝারি-উঁচু জমি সরিষা চাষের জন্য ভালো। জমি উন্মুক্ত স্থানে হওয়া দরকার, যাতে সেখানে সারাদিন রোদ পড়ে। এরকম জমি সরিষা চাষের জন্য উপযুক্ত।

জলবায়ু:

রাই সরিষা ঠান্ডা মরশুমে অর্থাৎ প্রধানত রবি মরশুমে চাষ করা হয়। ঠান্ডা মরশুমের স্থায়ীত্বের ওপর সরিষা ফলন নির্ভরশীল। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সকল অঞ্চলে শীত দীর্ঘস্থায়ী সে সকল অঞ্চলে রাই-সরিষার উৎপাদনশীলতা (ফলন প্রতি হেক্টর) সাধারনত তত বেশী হয়। পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে সরিষা সাধারনত আশ্বিন-কার্ত্তিক মাসে শীতের শুরুতে ‘বপন করে মাঘ-ফাল্গুনে অথবা চৈত্রের প্রথম পক্ষকালের মধ্যে শীত শেষ হওয়ার পর মাঠ থেকে তোলা হয়। বৃষ্টি নির্ভর ফসল হিসাবে চাষ করা হলে স্বল্প অথচ দীর্ঘ মেয়াদী শীত এবং সেই সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অল্প অল্প বৃষ্টি হলে সরিষা চাষের অনুকূল। রাই-সরিষার আকাঙ্খিত ফলনের জন্য দিনের বেলায় পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং রাত্রের বেলায় ঠাণ্ডা আবহাওয়া অর্থাৎ কম তাপমাত্রা আবশ্যক।

সরিষা চাষে বীজ হার

সরিষা চাষে বীজ হার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চাষি ভাইরা করেন কি, অনেক বেশি ঘন করে সরিষার বীজ বপন করেন। এতে করে সরিষার গাছ হয় লিকলিকে ও আপনার দানাগুলো পরিপুষ্ট হয় না। এইজন্য আপনাকে পরিমাণমতো অর্থাৎ হেক্টর প্রতি সাত থেকে আট কেজি বীজ বপন করতে হবে। অর্থাৎ 33 শতাংশের এক বিঘায়, এক কেজি বীজ বপন করলেই আপনি পর্যাপ্ত সংখ্যক গাছ পাবেন এবং পর্যাপ্ত ফলন পাবেন।

সরিষা চাষের জমি তৈরি

জমি তৈরি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তিন চারটি চাষ দিয়ে জমি সমান করে নেবেন। কোথাও উচু, কোথাও নীচু থাকলে গাছের অনেক সমস্যা দেখা দেয়। আপনি জমিটি সুন্দর চাষ দিয়ে সমান করে নেবেন।

বীজ বপনের পূর্বে কিছু করণীয় কাজ

বীজ বপনের পূর্বে অবশ্যই বীজটিকে হালকা রোদে দিয়ে, তারপর ঠাণ্ডা করে নেবেন। এর পরে বীজটিকে শোধন করে নিতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে বীজকে যেকোনো একটি কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক দিয়ে 2-3 গ্রাম পার কেজি বীজ শোধন করে নিতে হবে।

সরিষার বীজ বপন পদ্ধতি

সাধারণত আমাদের চাষি ভাইরা বীজ ছিটিয়ে বপন করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে আপনি সারিতে বীজ বপন করলে, পরিচর্যা করতে অনেক সুবিধা হয়।

সরিষা চাষে সার প্রয়োগ মাত্রা

প্রতি শতাংশে ইউরিয়া 800-1000 গ্রাম,
টিএসপি 600-750 গ্রাম,
এমওপি 350-400 গ্রাম,
জিপসাম 480-600 গ্রাম,
জিঙ্ক সালফেট 20-40 গ্রাম,
বোরিক অ্যাসিড 40-60 গ্রাম,
সুষম কম্পোস্ট 5-10 কেজি অথবা সাধারণ গোবর 20-40 কেজি প্রতি শতাংশে প্রয়োগ করতে পারেন।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি

সার প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ইউরিয়া সার বাদে, অন্য সারগুলো আপনি শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করবেন। ইউরিয়া সারটি 30-45 দিনের মধ্যে 2-3 কিস্তিতে প্রয়োগ করবেন

সরিষা চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা

সরিষা চাষে সেচ ব্যবস্থাপনাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জমির রসের ঘাটতির উপর বিবেচনা করে, দুই-তিনটি সেচ আপনি সরিষা ক্ষেতে দিতে পারেন-

বীজ বপনের 10-15 দিনের মধ্যে,
30-35 দিনের মধ্যে অর্থাৎ গাছে ফুল আসার আগে,
এরপরে 50-55 দিনের মধ্যে অর্থাৎ ফল ধরার সময় তৃতীয় সেচ দিতে পারেন।

ফসলের অতিরিক্ত চারা অপসারণ

আপনার জমিতে যদি খুব বেশি ঘন চারা জন্মে, এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে চারা পাতলা করে দিতে হবে। চারা পাতলা করে দিলে, গাছ সুষম মাত্রায় আলো বাতাস এবং সার পাবে। প্রতি এক বর্গমিটার জায়গার জন্য জাত ভেদে 45-65টি গাছ থাকলেই পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলন পাওয়া যাবে।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *