গ্রীস্মে রঙ্গন ফুল গাছ প্রতিস্থাপন ও পরিচর্যা | Easy to Care Ixora Flower

রঙ্গন ফুল গাছ বারো মাস শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ হিসেবে সকল বাগান প্রেমিকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। ঘন সবুজ পাতার আড়ালে লাল, গোলাপী, হলুদ, কমলা ও সাদা রঙের ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। গ্রাম থেকে শহর প্রায় সকল স্থানেই এই রঙ্গন ফুল (Ixora) গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

রঙ্গন ফুল গাছের আরেক নাম রুক্সিনী। এর ইংরেজি নাম Jungle geranium, Flame of the woods, Jungle flame। বৈজ্ঞানিক নাম Ixora coccinea, এটি রুবিয়াসেই (Rubiaceae) পারিবারের অন্তর্গত, আদি নিবাস ব্রাজিল। আজকে প্রতিবেদন থেকে আপনি টবে রঙ্গন ফুল গাছ প্রতিস্থাপন করার পদ্ধতি ও পরিচর্যা সম্পর্কে জানতে পারবেন। আপনি যদি আপনার টবে রঙ্গন ফুল লাগাতে চান তবে আপনাকে এই সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি অনুসরণ করতে হবে। এই প্রতিবেদন থেকে আপনি টবে রঙ্গন ফুল গাছের পরিচর্যা সম্পর্কে সমস্ত প্রয়ােজনী তথ্য জানতে পারবেন।

গ্রীস্মে রঙ্গন ফুল গাছ প্রতিস্থাপন ও পরিচর্যা

বিবরণ ও পরিচিতি:-

রঙ্গন ফুল গাছ একটি কষ্টসহিষ্ণু, গুল্মজাতীয় চিরসবুজ উদ্ভিদ। এ গাছের পরিচর্যা অন্যান্য গাছের তুলনায় কম প্রয়োজন। জল ও তুলনামুলক অনেক কম লাগে। যারা ছাদ বাগান করতে ইচ্ছুক, তারা ছাদে দুই একটা রঙ্গন গাছ টবে রাখতে পারেন। এতে ছাদের সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি পায়। এর চাষ পদ্ধতিও সহজ। ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেলে শীতের পরপর ডাল কাটাই- ছাঁটাই করে দিতে হবে।

রঙ্গন ফুল গাছ বারো মাস শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত হলেও বসন্তের শুরু থেকে শরৎ ঋতু প্রযন্ত অধিক ফুল ফোঁটে। অন্যান্য মরসুমে তুলনামূলক ফুল কম ফোটে। প্রায় প্রতি শাখার অগ্রভাগে থোকায় থোকায় লাল, সাদা, হলুদ এবং গোলাপী বর্নের প্রচুর ফুল ফোটে, থোকায় থাকে অসংখ্য মঞ্জুরি। ফুলের নলাকৃতি অংশে মধু থাকায় প্রজাপতি আকর্ষিত হয়। অন্যান্য ফুলের তুলনায় রঙ্গন ফুলের স্থায়িত্বও অনেক বেশি, সতেজ থাকে ২০-২৫দিন পর্যন্ত। প্রতিটি থোকায় ২০ টি থেকে ৫০ টি ফুল থাকে এবং ফুলগুলি নলাকৃতি হয়। ফুলে চারটি পাঁপড়ি থাকে, অনেকটা তারার মতো দেখতে হয়, তবে ফুলগুলি গন্ধহীন। ফুল ঝড়ে যাবার বেশ কিছুদিন পরে গাছে ফল হয়।

রঙ্গন ফুল গাছের যত্ন

রঙ্গন গাছকে বাংলাতে রুক্মিনী, রক্তক, বন্ধুক, ঈশ্বর ও বলা হয়, এর আরেক নাম রুক্সিনী। ইংরেজিতে বলা হয় Burning Love (বার্নিং লোভে)। অসামান্য সুন্দর দেখতে এই রঙ্গন ফুলগুলি বছরের অধিকাংশ সময়ে বাগানকে আলো করে রাখবে।

স্থান নির্বাচন:-

রঙ্গন ফুল গাছ মোটামুটি দিনে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা সূর্যের আলো পাই তেমন স্থানে গাছ প্রতিস্থাপন করা উচিত, এতে গাছের বাড়বাড়ন্ত ভালো হয় এবং রোগে আক্রান্ত কম হয়। রঙ্গন গাছ মাটিতে বসানোর ৫- ৬ মাস পরেই ফুল আসা শুরু হয়। রঙ্গন গাছ সমতল অথবা ঢালু উভয় স্থানেই প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।

মাটি প্রস্তুত:-

যে কোনও মাটিতেই রঙ্গন গাছ জন্মায়। তবে দোঁয়াশ ও বেলে-দোঁয়াশ মাটি রঙ্গন গাছের জন্য আদর্শ। টবে রঙ্গন গাছ প্রতিস্থাপন করতে হলে প্রথমেই যেটি করবেন, পরিমান মতো দোঁয়াশ মাটির এর সাথে জৈব সার: ভার্মি কম্পোস্ট/ গোবর সার/পাতা পচা সার ও স্টেরা মিশিয়ে নেবেন। এতে টবের মাটি ভাল থাকবে। এর সঙ্গে কিছুটা সরিষার খৈল, হাঁড় গুঁড়ো, শিং কুঁচি ও কিছুটা টিএসপি/ ডিএপি সার মিশিয়ে মাটিতে সামান্য জল ছিঁটিয়ে ১৫ দিনের জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখবেন, দেখবেন ১৫ দিন পরে মাটি তৈরি হয়ে গেছে।

টব নির্বাচন:-

রঙ্গন একটি বহুবর্ষজীবী ও ঝোঁপের ন্যায় উদ্ভিদ তাই ভালো হয় বড় গামলা জাতীয় মাটির টব নির্বাচন করলে। প্রথম অবস্থাতে চারা গাছ ৮ ইঞ্চি টবে প্রতিস্থাপন করলেও এক থেকে দেড় বছর পারে ১০ ইঞ্চি অথবা ১২ ইঞ্চি টবে স্থানন্তিরিত করতে হবে। তবে এক থেকে দেড় বছর অন্তর গাছের মাটি পরিবর্তন করতে হবে। টব নির্বাচন করবার সময় টবের তলানিতে এবং পাশে অবশ্যই যেন ছিদ্র থাকে, সেই বিষয় নিশ্চিৎ করতে হবে।

জল প্রয়োগ:-

গাছের গোড়ায় অতিরিক্ত জল প্রয়োগ এবং অতি কম দেওয়া উভয়ই গাছের জন্য ক্ষতিকর। মাত্রারিক্ত জল দেয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে গাছ আক্রান্ত হয়, এমনকি মারা যায়। এ জন্য গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার পূর্বে পর্যবেক্ষণ করে, তবেই জল প্রয়োগ করবেন, গোড়া ভেজা থাকলে কোনো মতেই তাতে জল দেয়া যাবে না। গরমকালে টবের গাছে দিনে দুবেলা মগ ভর্তি করে জল দেবেন। বর্ষাকালে মাটি বুঝে গাছে জল প্রয়োগ করবেন এবং শীতকালে সপ্তাহে একদিন জল দিলেই যথেষ্ট।

জলবায়ু:-

রঙ্গন ফুল গাছ চাষের জন্য খুব বেশী আর্দ্র মাটি প্রয়োজন হয় না। তবে মাটি যাতে বেশী ভিজে কাদা কাদা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর কোনো কারণে মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে সেই কয়েক দিন জল দেওয়ার বন্ধ করে দিতে হবে। মাটি শুঁকিয়ে গেলে তার পরে জল দিতে হবে।

[আরও পড়ুন: গরমে বেলি ফুল গাছের যত্ন | How to Care Mogra Plant]

পরিচর্যা:-

রঙ্গন গাছে জৈব সার ব্যাবহার করলে গাছ বেশ দিন স্থায়ী হয়। শীতের মরসুমে গাছের ডাল ছেঁটে দিতে হবে, দেখবেন গরমের মরসুম শুরু হতেই নতুন নতুন শাখা প্রশাখা তৈরী হতে শুরু করবে, এই সময় থেকে গাছের গোড়ায় নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার ব্যাবহার করতে হবে। প্রায়োজনে ১৫ দিন অন্তর সরিষার খোল জল পাতলা করে টবের মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। এটি স্বাভাবিক মাটির পিএইচ বজায় রাখতে সাহায্য করবে। দেড় দুই মাস পর থেকে জৈব সারের মধ্য গোবর সার / পাতাপচা, ডিমের খোসা, কলার খোসা, হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি, হাঁফ চামচ সরষের খোল, Micronutrients, প্রভৃতি একত্রে মিশিয়ে ব্যাবহার করা যেতে পারে। প্রত্যেক মাসে একবার করে এটি ব্যাবহার করলে অন্য কোন সারের প্রয়োজন হবে না এতে গাছ সারা বছর সুস্থ এবং সতেজ থাকবে এবং গাছে ফুলের পরিমান অনেক গুন বৃদ্ধি পাবে।

অথবা গাছ বড় হয়ে গেলে প্রতি এক মাস অন্তর ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি টবের জন্য ৮ থেকে ১৫ টি ডি.এ.পি দানা

য়ে দিতে হবে এবং ডি.এ.পি ব্যাবহারের ১৫দিন পর এক চামচ পটাশ সার গোড়া থেকে দূরে টবের মাটিতে দিয়ে দিতে পারেন। রাসায়নিক সার ব্যাবহারের ১৫- ২০ দিন পর যে কোন কম্পোস্ট সার মাটিতে দেওয়া যেতে পারে।

টবে গাছ প্রতিস্থাপনের ১ থেকে ২ মাসের মধ্য কোন জৈব বা রাসায়নিক সার প্রয়োগ না করাই ভাল, কিছু মাস পর থেকে অল্প জৈব সার দিলে ভালো হয়।শীতকালে এই গাছের বিশেষ খাবারের প্রয়োজন হয় না কিন্তু গরমের শুরু থেকে এদের খাবারের চাহিদা বেশি থাকে কারণ এ সময় গাছে প্রচুর কুঁড়ি আসতে শুরু করে। সঠিক যত্ন এবং পরিচর্যা করলে টানা বর্ষা পর্যন্ত এই গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। গরমের মরসুমে এবং বর্ষার মরসুমে গাছ ভর্তি ফুল পেতে চাইলে প্রতি মাসে একবার করে অল্প পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে।

ডাল ছাঁটাই:-

একটি সতেজ গাছ তৈরির প্রক্রিয়াটি হল গাছটি বড় হলে ডগাটি ছেটে দিতে হবে। এরপর কয়েকদিন পর কান্ডের পাশ থেকে শাখা বের হবে, তাদের মধ্যে কয়েকটি শাখা রেখে বাকীগুলি ছিড়ে ফেলুন। এরপর গাছের গোড়ায় মাটি দিন। বেশী ফুল পেতে হলে গাছের আগা ভেঙ্গে দিন। এতে ঝাকড়ানো গাছ হবে। ফুল ফোটা শেষ হয়ে গেলে রঙ্গন গাছ ছেটে দেওয়া ভালো। সাধারণত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে রঙ্গন ফুল বেশী ফোটে। এর মধ্যে বর্ষাকালে এই ফুল বেশী পরিমানে ফোটে। যদিও সারা বছর এই ফুল ফোটে। বর্ষাকালের প্রথমে ও শীতকালে ডাল ছাঁটতে হবে। ছাঁটাই এর পরে চাউবান্টিয়া পেন্ট ব্যবহার করুন।

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *