স্বল্প মেয়দী অশ্বগন্ধা চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন বহু চাষী ভাইয়েরা, অশ্বগন্ধা একটি ভেষজ উদ্ভিদ যায় বীজ, মূল এবং পাতা বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ভারত, পাকিস্তান এবং উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু স্থানে এটি চাষ করা হয়। অশ্বগন্ধার মূল শতাব্দী ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যাবহার হয়ে আসছে। বর্তমানে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে অশ্বগন্ধা একটি স্বাস্থ্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে প্রদাহ কমাতে, স্ট্রেস কমাতে, মানসিক ক্রিয়াকলাপ উন্নত করতে, বার্ধক্যজনিত কর্মহীনতার, শরীরকে শক্তি জোগাতে, কার্যকরী এবং এটি টিউমার নিরাময়ও করতে পারে।
বর্তমানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ যেমন কমছে তেমন চাষীরা সবজী বা ফসল চাষ করেও সঠিক বাজার মূল্য দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় প্রত্যকে বিকল্প চাষ খুঁজছেন। কৃষকদের আয় বাড়াতে, জমিতে বিকল্প চাষের পরামর্শ দিচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উদ্যান পালন দপ্তর ৷ তাদের পরামর্শে ইতিমধ্যেই নদীয়ার বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমারের উদ্যগে ওষুধি এবং মশলা জাতীয় চাষ শুরু হয়েছে।
স্বল্প মেয়দী অশ্বগন্ধা চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন বহু চাষী
ওষুধি এবং মশলা জাতীয় চাষের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেক কৃষকেরা। ‘আত্মা’ প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তায় ডোমকলের জিৎপুর, সারাংপুর, রমনা, বসন্তপুর প্রভৃতি এলাকা এছাড়াও করিমপুরের বিভিন্ন জমিতে অশ্বগন্ধা চাষের ক্ষেত্র প্রদর্শনী ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও হরিয়ানা, রাজস্থান, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশে অশ্বগন্ধা গাছের চাষ, এর শিকড় বা মূলের জন্য করা হয়। যার ওষুধি গুণ অপরিসীম। বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে এই গাছের শিকড় ব্যাবহার করা হয়। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স ও তরাই অঞ্চলের আবহাওয়া অশ্বগন্ধা চাষের পক্ষে উপযোগী।
অশ্বগন্ধা চাষের সময়:
অশ্বগন্ধা গাছ মূলত বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার ঘটানো হয়। জমিতে এর বীজ বোনার আদর্শ সময় হল অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বীজ বোনার আগে জমি তৈরি করা হলে সহজেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
বীজের হার:
অশ্বগন্ধা চাষ করতে বিঘা প্রতি দেড় কিলোগ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। বীজগুলি খুবই হালকা এবং দেখতে ছোট আকারের। এর অঙ্কুরোদ্গমের হারও খুব বেশি হয় না, নানা কারণে কিছু চারা নষ্ট হয়ে যায়। যার জন্য জমিতে বীজ ছিটানোর সময় একটু বেশি পরিমানে ছিটিয়ে রাখলে আখড়ে লাভই হবে। বীজ বপণের আগে সেপ্টেম্বর থেকে জমি তৈরি করতে হবে।
বীজ শোধন:
বীজ বাহিত রোগ থেকে চারা রক্ষা করার জন্য বীজ বপনের পূর্বে 3 গ্রাম/কেজি হারে থিরাম বা ডাইথেন এম-৪৫ (ইনোফিল এম-৪৫) @৩ গ্রাম/ প্রতি কেজি দিয়ে বীজ শোধন করা উচিত। শোধনের পর বীজগুলিকে বাতাসে শুকিয়ে তারপর জমিতে বপন করতে হবে।
[ আরো দেখুন: লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা ]
জমি প্রস্তুত এবং বপন পদ্ধতি :
অশ্বগন্ধা চাষের জন্য বেলে দোঁয়াশ বা হালকা লাল মাটি একদম আদর্শ, যার pH মাত্রা ৬.৫ থেকে ৭.৫ হলে ভালো হয়।তবে মাটিতে অম্লত্বর পরিমাণ ৬.৫-এর কম হলে বিঘা প্রতি ১২৫ কেজি চুন বা ডলোমাইট ব্যবহার করতে হবে। উষ্ণ ও শুকনো আবহাওয়া অশ্বগন্ধা চাষের পক্ষে আদর্শ। জমিতে যাতে জল না জমে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
২ থেকে ৩টি লাঙ্গল দিয়ে জমি ভালভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে যাতে মাটির বড় অংশ না থাকে অর্থাৎ একটি সূক্ষ্ম চাষে আনতে হবে। প্রথম বার চাষ দেওয়ার পরে জৈব সার( বিঘা প্রতি ৪ টনের মতো গোবর সার ও জৈবসার মাটিতে ভালো করে মিশিয়ে দিতে ) দ্বিতীয়বার চাষ দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হয়। এর পর বীজ বোনার আগে জমিতে জল দেওয়ার পূর্বে চুন সাথে দানাদার কীটনাশক হিসেবে ফিউরাডন দেড় থেকে দু’কেজি প্রতি বিঘায় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হয়। যাতে শিকড় ছিদ্রকারী পোকা জমির গাছের ক্ষতি করতে না পারে। বীজ জমিতে ঘন ভাবে ছিটিয়ে বোনা হয়। তবে সারিবদ্ধভাবে বুনলে গাছের পরিচর্যায় সুবিধা হয়।
তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত:
অশ্বগন্ধা চাষের জন্য ৩০০ থেকে ৩৫০ মিমি বৃষ্টিপাত সহ উষ্ণ ও শুকনো আবহাওয়া অশ্বগন্ধা চাষের জন্য উপযুক্ত। অশ্বগন্ধা চাষের জন্য গড় ২০-২৫° সে তাপমাত্রা প্রয়োজন, তবে ফসল বৃদ্ধির সময় শুষ্ক আবহাওয়া প্রয়োজন। শীতের শেষের দিকে বৃষ্টিপাত গাছের শিকড়ের সঠিক বিকাশের জন্য সহায়ক।
সেচ:
অশ্বগন্ধা চাষে অতিরিক্ত জল দেওয়া বা বৃষ্টি ফসলের ক্ষতি করতে পারে। বৃষ্টিপাত বেশি হলে সেচের প্রয়োজন বিশেষ হয় না অন্যথায় একবার বা দুবার সেচ দিলে হবে। গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেচের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাটিতে আদ্রতা বুঝে সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচ অঙ্কুরোদগমের ৩০ থেকে ৪০ দিন পর অর্থাৎ (গাছের উচ্চতা ২ থেকে ৪ ইঞ্চি হলে) একবার সেচ এবং তারপর দ্বিতীয় সেচ ৬০ থেকে ৭০ দিন পর দিতে হবে।
পাতা বা কান্ডে দাগ
অশ্বগন্ধা গাছের পাতায় এবং কান্ডে ছত্রাকজনিত, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল রোগের কারনে পাতায় বিবর্ণ দাগ সৃষ্টি হয়। এর প্রতিকারে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি ৪ গ্রাম/ প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে সন্ধাতে স্প্রে করতে হবে। অথবা সাফ পাউডার দু’গ্রাম/ প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
সার প্রয়োগ:
অশ্বগন্ধা চাষে বেশি সারের প্রয়োজন হয় না। তবুও বীজ বোনার ৩০-৪০দিনের মাথায় প্রথম চাপান হিসেবে ৮ কেজি ১০ : ২৬ : ২৬ (NPK) সার প্রয়োগ করে জল দিতে পারলে ভাল হয়। পরে ৬৫ থেকে ৭৫ দিনের মাথায় আরও একবার সার দিতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ:
প্রতিনিয়ত জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। অশ্বগন্ধা চাষে তেমন ধরনের কোনো পোকার উপদ্রপ দেখা যায় না। রোগপোকা দমনেও রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে নিমতেল বা জৈব কীটনাশক ব্যবহার করলে ভাল হয়। অশ্বগন্ধা ভেষজ জাতীয় উদ্ভিদ হওয়ায় কোনও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ না করা ভাল। তবে কোন কোন সময়ে মাইট, এফিডস, কালো মাছির উপদ্রব দেখা যায়।
ফসল সংগ্রহ:
ডিসেম্বর থেকে গাছে ফুল ও ফল ধরা শুরু হয়। বীজ বোনার ১৭০ থেকে ১৮০ দিন পর মার্চ-এপ্রিল মাসে ফসল তোলা জন্য প্রস্তুত হয়। এই সময় গাছের ফলগুলি পেকে যায় এবং মাটির নিচের মূল বা শিকড়গুলিও পুষ্ট হয়। যেহেতু শিকড় সংগ্রহের জন্য গাছগুলি উপড়ে তোলা হয় তাই তোলার আগে একটা জলসেচ দিয়ে মাটি নরম করে নেওয়া জরুরি। গাছ উঠিয়ে নেওয়ার পর ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। আর মূলগুলি কাঁচা অবস্থায় অথবা শুকিয়ে নিয়েও তা বাজারজাত করা যায়। প্রতি বিঘায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি বীজ পাওয়া যায়। আর শিকড় পাওয়া যায় ১২ থেকে ১৫ কুইন্টাল। যা থেকে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আয় করা কষ্টসাধ্য নয়।
[ আরো দেখুন: লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা ]