আঁশফল বা কাঠলিচু কোন সময়ে হয় , কিভাবে বাড়িতে এই গাছের যত্ন করবেন

আঁশফল লিচু প্রজাতির একটিই সুস্বাদু গাছ, যা ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় । মনে করা হয় এর আদি বাসস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে। আঁশফল বা কাঠলিচু গাছ চিরসবুজ, ফলবিহীন গাছ দেখলে মনে হবে লিচুগাছ। লিচুর মরসুম শেষ হলেই গ্রাম বাংলায় আনাচে কানাচে এই ধরনের গাছে ফল দেখতে পাওয়া যায়। অনেকের কাছে এটি ‘কাঠলিচু’ বা ‘লংগান’ নামে পরিচিতি। এই ফল থোকায় থোকায় লিচুর মতোই ঝুলে থাকে । এটি দেখতেও অনেকটা লিচুর মতো গোলাকার, তবে আকারে ছোট এবং এর রসাল অংশ খুবই কম।

আঁশফলের বৈজ্ঞানিক নাম Dimocarpus longan এটি স্যাপিন্ডেসি (Sapindaceae) পরিবারভুক্ত একটি বৃক্ষ জাতীয় চিরসবুজ উদ্ভিদ। এ পরিবারের আরও একটি ফল আছে, তার নাম রাম্বুতান। আজকের প্রতিবেদন থেকে আপনি কাঠলিচু বা আঁশফল গাছের প্রতিস্থাপান, পরিচর্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জনতে পারবেন।

পরিচিতি:

আঁশফল নানা স্থানে নানা নামে পরিচিত কোথাও বলা হয় কাঠলিচু, ছোট লিচুু অবার কোথাও বলা হয় লংগান ফল। তবে আভিধানিক নাম আঁশফল। এই আঁশফল ও লিচু ফল ধরার সময় প্রায় একই। ফল দেখতে অনেকটা লিচুর মতো, গোলাকার তবে পাঁকলে খোসা লাল বর্নের হয় না। তবে ফলের আকার ছোট, রসাল অংশ খুবই কম। লিচুর চেয়ে আমিষের পরিমাণ বেশি। গাছ ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে, এদের পাতা চওড়া এবং লম্বায় ২ ইঞ্চি হয়। এ গাছের ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা কম।ইদানীং বাণিজ্যিকভাবে এই ফলের চাষ শুরু হয়েছে। আঁশফল বা কাঠ লিচু আমাদের দেশের স্থানীয় ফল হলেও এই ফলের গুণগতমান তেমন ভালো নয়। । সম্প্রতি বাংলাদেশে আঁশফল বেশ কিছু উন্নতমানের জাত প্রবর্তনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বীজ সংগ্রহ করতে হয়।

ফলের উপরিভাগ মসৃণ, ফলের রঙ বাদামি, আকার গোল এবং লিচুর চেয়ে অনেক ছোট হলেও ফলের শাঁস অবিকল লিচুর মতো এবং ফল খেতে প্রায় লিচুর মতো বা লিচুর চেয়ে বেশি মিষ্টি। আঁশফলে প্রচুর পরিমাণে শর্করা ও ভিটামিন ‘সি’ থাকে। এ ফলের শাঁস সাদা, কচকচে।সাধারণত আগস্ট মাসের শেষার্ধ থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত আঁশফল আহরণ করা হয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে লিচুর স্বাদ গ্রহণ ও ফলের মৌসুম দীর্ঘায়িত করতে আঁশফল বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তার নাম রাম্বুতান। সম্প্রতি আঁশফল, রাম্বুতান ফল দুটি বাংলাদেশে সাফল্যজনকভাবে প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছে।

পুষ্টিমান ও ঔষধিগুণ:

এ ফল লিচুর মতো সুস্বাদু না হলেও পুষ্টিগুণ রয়েছে প্রচুর। এই ফল উদারাময় নিবারক ও কৃমিনাশকে দারুণ কার্যকর। অনেকে এই ফলকে বলকারক হিসেবে মনে করে।

আঁশফলে বিভিন্ন খনিজ উপাদান, শর্করা ও ভিটামিন সি এর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশে ৭২ ভাগ পানি, ১০৯ কিলোক্যালোরি শক্তি, ৮.০ মিগ্রা. ভিটামিন সি, ২৮০ আইইউ ভিটামিন এ, ২.০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ৬.০ মি.গ্রা. ফসফরাস, ১.০ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৫ গ্রাম ফ্যাট বিদ্যমান। আঁশফলের শুকানো শাঁস ভেষজ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন- এটি পাকস্থলীর প্রদাহে, অনিদ্রা দূর করতে ও বিষের প্রতিষেধক (antidote) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা অ্যালার্জি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও কার্ডিওভাসকুলার রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা যায়।

দুর্বলভাব কমাতে: শরীর দুর্বল অনুভব হলে আঁশফলের শুকনা খোসা ভালভাবে গুঁড়া করে একগ্লাস গরুর দুধের সাথে পাঁচ গ্রাম হারে সকালে খেলে শরীরের শক্তি ফিরে আসে।

জ্বর নিরাময়ে: জ্বর হলে কাঠলিচু বা আশঁফলের খোসা ভালভাবে বেটে চার গ্রাম আধ গ্লাস ঠাণ্ডা জলের সাথে সকালে একবার খেলে নিশ্চিত উপকার হয়।

ক্রিমি সমস্যায়: পেটে ক্রিমি হলে আঁশফল ছেঁচে বা বেটে তিন থেকে চার গ্রাম পরিমাণ এক কাপ সামান্য গরম জলের সাথে সকালে খালিপেটে খেলে ক্রিমি মৃত অথবা জীবন্ত অবস্থায় মলের সাথে বেরিয়ে যায়।

পাতলা পায়খানা সারাতে: পাতলা পায়খানা বাউদরাময় হলে কাঁচা আঁশফলের রস ১০ থেকে ১৫ ML খেলে সমাধান পাওয়া যায়।

বিষক্রিয়া নষ্ট করতে: এর ফল বেশ সুস্বাদু না হলেও রসালো । টকজাতীয় স্যুপ রান্নার জন্য এই ফল ব্যবহার করা হয়। সাপ বা কোন কীটের বিষ নষ্ট করতে এর ফল বেশ উপকারী।

মাটি ও জলবায়ু:

আঁশফল প্রধানত গ্রীষ্মের ফল। এটি ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের উদ্ভিদ হলেও উষ্ণ ও আর্দ্র গ্রীষ্মকাল এবং শুষ্ক শীতকাল পছন্দ করে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় এই গাছ মারা যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৫০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত স্থানে আঁশফল জন্মে। আঁশফলের জন্য বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২০-২৫ উপযোগী। রাতের তাপমাত্রা ২৫ উপরে হলে ফলের বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই আঁশফল চাষ করা যায়। তবে উর্বর সুনিষ্কাশিত দোঁয়াশ মাটি আঁশফল চাষের জন্য উত্তম। এ গাছ জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা একেবারে সহ্য করতে পারে না। ফল ধারণ থেকে ফলের পরিপক্বতা পর্যন্ত মাটিতে প্রচুর আর্দ্রতা প্রয়োজন।

আঁশফল গাছ

জমি নির্বাচন ও মাটি তৈরি :

আঁশফল চাষের জন্য ঢালু ও মাঝারি উঁচু জমি প্রয়োজন। জমি নির্বাচন করা হলে জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে গোবর সার ছিটিয়ে মই দিতে হবে এবং দীর্ঘজীবী আগাছা সমূলে অপসারণ করে ভালোভাবে জমি তৈরি করতে হবে।

চারা-কলম নির্বাচন :

রোপণের জন্য কমপক্ষে এক বছর বয়েসের সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত কলমের চারা নির্বাচন করতে হয়।

গর্ত তৈরি :

চারা নির্বাচন হয়ে গেলে ৫ মি. x ৫ মি. দূরত্বে বা ১৫ ফুট দূরত্বে ১ মি. x১ মি. x১ মি. আকারের গর্ত করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈবসার বা গোবর সার, ২০০ গ্রাম ডিএপি/টিএসপি ও ২০০ গ্রাম নিমখোল ভালোভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে তাতে জল দিতে হবে।

রোপণ পদ্ধতি :

সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তকার বা ১০ ফুট অন্তর চারা রোপণ করা যেতে পারে। কিন্তু উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকায় কন্টুর রোপণ পদ্ধতিতে চারা রোপণ করা উত্তম।

রোপণের সময় :

আঁশফল গাছের চারা রোপণের আদর্শ সময় জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস। তবে সেচের সুব্যবস্থা থাকলে সারা বছরই আঁশফলের চারা-রোপণ করা যেতে পারে।

চারা-কলম রোপণ ও পরিচর্যা :

গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে নির্বাচিত চারাটি খাঁড়াভাবে রোপণ করে চারার চারদিকের মাটি হাত দিয়ে ভালোভাবে চেপে দিতে হয়। চারা রোপণের পর শক্ত খুঁট পুঁতে খুঁটির সঙ্গে চারাটি বেঁধে দিতে হবে যাতে বাতাসে চারার কোনো ক্ষতি না হয়। প্রয়োজনবোধে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোপণের পরপরই সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছে সার প্রয়োগ :

গুণগতমানসম্পন্ন উচ্চফলন পেতে হলে আঁশফলে নিয়মিত সারপ্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফল সংগ্রহের পর ১ম বার সার প্রয়োগ করতে হবে, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মুকুল আসার সময় ২য় বার এবং জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজের রঙ ধারণপর্যায়ে ৩য় বার সার প্রয়োগ করতে হয়।

পোকামাকড় ও রোগবালাই:

আঁশফল গাছে তেমন পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হতে দেখা যায় না। তবে ফলের পরিপক্ব পর্যায়ে পাখি (ফিঙে, বাদুর, দোয়েল) ফল খেয়ে প্রচুর নষ্ট করে । তাই প্রত্যেক গাছ সম্পূর্ণভাবে নেট দিয়ে আবৃত করে ফল রক্ষা করতে হবে।

এ ফল পাকলে কালো পিঁপড়ের উপদ্রব বেড়ে যায় ।

দমন ব্যবস্থা : বাগানের আশপাশে পিঁপড়ার বাসা থাকলে তা ধ্বংস করে ফেলতে হবে। সেজন্য মাটিতে ডারসবান ২০ ইসি @ ২ মিলিলিটার বা লরসবান ১৫ জি ৫ গ্রাম/লিটার হারে প্রয়োগ করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে গাছে ক্লোরপাইরিফস ২০ ইসি বা ডারসবান ২০ ইসি ১.৫ মিলিলিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ফল সংগ্রহের অন্তত ১৫ দিন পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

ফল সংগ্রহ:

ফাল্গুন-চৈত্র (মার্চ) মাসে ফুল আসে এবং শ্রাবণ-ভাদ্র (আগস্ট) মাসে ফল পাকে। সম্পূর্ণ পাকার পর ফল গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আবার ফল বেশি পেকে গেলে গাছ থেকে ঝরে পড়ে ও ফেটে যায়, যা গাছের ফলনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তাই সময়মতো ফল সংগ্রহ আঁশফলের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *