শীতের ফুল- গ্লাডিওলাস ফুল গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা

Last updated on January 20th, 2024 at 11:24 pm

শীতের বিভিন্ন ফুলের মধ্যেও গ্লাডিওলাস ফুলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফুলের লম্বা স্পাইকগুলির সাথে আকর্ষণীয় রঙ, গঠন এবং দীর্ঘ সময় সজীব থাকে বলে গ্লাডিওলাস ফুল উদ্যানপালকদের মোহিত করে। ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর নানা দেশে এই ফুলগুলি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।

গ্ল্যাডিওলাস, সোর্ড লিলি নামেও পরিচিত। এটি Iridaceae আইরিস পরিবারের অন্তর্গত, গ্ল্যাডিওলাস বহুবর্ষজীবী এবং নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে জন্মায়। গ্ল্যাডিওলাস গোলাকার বাল্বের দ্বারা বংশবিস্তার ঘটে। গ্ল্যাডিওলাসের প্রায় ২৬০টি প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে ২৫০টি সাব-সাহারান আফ্রিকার স্থানীয় উদ্ভিদ এবং ১০টি প্রজাতি ইউরেশিয়ার স্থানীয় উদ্ভিদ। সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য আর্দ্র ও ঠান্ডা আবহাওয়া (১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) দরকার। গ্ল্যাডিওলাস চাষের জন্য পূর্ণ সূর্যের আলো সহ উর্বর মাটি প্রয়োজন। কারণ এই ফুল ছায়ার ভালো হয় না।

শীতের ফুল- গ্লাডিওলাস ফুল গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা

গ্ল্যাডিওলাস ফুল গাছের জাত নির্বাচন:

গ্লাডিওলাস ফুলের ২৬০টি প্রজাতি রয়েছে। আর এই গ্লাডিওলাস ফুলগুলোকে বৃহদাকার, ক্ষুদ্র ফুল, বড় ফুল এবং প্রজাপতি ইত্যাদি নামে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়ে থাকে,এছাড়াও এই ফুলের মধ্যে সিঙ্গেল ও ডাবল জাতও বিদ্যমান। জাতভেদে গ্লাডিওলাস ফুল বিভিন্ন রঙের হয়, যেমন-সাদা, গোলাপী, হলুদ, ফিকে লাল, লাল, কমলা, গাঢ় লাল, বেগুনী প্রভুতি। নিম্নে কিছু জনপ্রিয় গ্ল্যাডিওলাস জাত উল্লেখ করা হল..

  • গ্র্যান্ড ফিনালে (Grand Finale): এর বৃহৎ, স্পন্দিত বর্ণে ফুলে ফুলে, গ্র্যান্ড ফিনালে হল একটি শোস্টপার যা যে কোনো বাগানের প্রদর্শনে নাটকীয়তা এবং ফ্লেয়ার যোগ করে।
  • নোভা লাক্স (Nova Lux): একটি মার্জিত স্পর্শের জন্য, নোভা লাক্স বিশুদ্ধ সাদা ফুল অফার করে যা সবুজ পাতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে, এটি বিভিন্ন আয়োজনের জন্য একটি ক্লাসিক পছন্দ করে তোলে।
  • ফ্লেভো কুল (Flevo Cool): এই জাতটি ল্যাভেন্ডার এবং বেগুনি রঙের একটি অনন্য মিশ্রণ নিয়ে গর্ব করে, যে কোনো বাগানের পরিবেশে একটি চিত্তাকর্ষক এবং নজরকাড়া ডিসপ্লে তৈরি করে।
  • প্রিন্স ক্লজ (Prins Claus): সাদা পাপড়ি এবং আকর্ষণীয় লাল চিহ্ন সহ দ্বি-রঙের ফুলের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, প্রিন্স ক্লজ ফুলের বিছানায় পরিশীলিততা এবং বৈপরীত্যের ছোঁয়া যোগ করে।

গ্লাডিওলাস ফুল চাষের আদর্শ স্থান ও মাটি নির্বাচন:

গ্লাডিওলাস ফুল চাষের জন্য জৈব সার যেমন কম্পোস্ট বা ভাল পচা সার (পাতা পচা অথবা গোবর সার) সাথে বেলে দোঁয়াশ অথবা দোঁয়াশ মাটি মিশিয়ে নিতে হবে। আর এই ফুল চাষের জন্য উঁচু অথবা ঢালু স্থান নির্ধারণ করতে হবে যাতে বৃষ্টি অথবা সেচের জল জমে থাকে না। গ্লাডিওলাস ৬.০ এবং ৭.০ এর মধ্যে pH সহ ভাল-নিকাশী মাটি পছন্দ করে।

দিনে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা সরাসরি সূর্যের আলো গ্লাডিওলাস গাছের জন্য প্রয়োজন। কম আলো অথবা ছায়া স্থানে ফুলের পারিমান এবং ফুলের উজ্বলতা কমে যায়।

তবে অধিক কাদাযুক্ত অথবা ভারী মাটিতে এই গ্লাডিওলাস ফুল চাষ না করাই উচিৎ। এই ফুল চাষের জন্য সর্বদা হালকা মাটির সাথে জৈবসার মিশিয়ে মাটির গুণাগত মানউন্ন্যত করতে হবে।

গ্ল্যাডিওলাস বাল্ব রোপণ:

গ্ল্যাডিওলাস উর্বর মাটি সহ পূর্ন সূর্যের আলো পাই এমন একটি নির্বাচন করতে হবে। গ্ল্যাডিওলাস নিরপেক্ষ মাটির pH থেকে সামান্য অম্লীয় পছন্দ করে। সর্বদা রোগবিহীন বড় মাপের .গ্ল্যাডিওলাস বাল্ব সংগ্রহ করতে হবে, মাটি থেকে প্রায় 6 থেকে 8 ইঞ্চি গভীরে মাটি খনন করে , বাল্বগুলিকে সূক্ষ্ম প্রান্তের দিকে মুখ করে বসিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি বাল্ব প্রায় 4 থেকে 6 ইঞ্চি দূরে বসাতে হবে, যাতে সঠিক বায়ু সঞ্চালন হয়। এবার বাল্বগুলিকে মাটি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে অল্প জল ছিটিয়ে দিন। সম্ভব হলে মালচের একটি স্তর যুক্ত করবেন, তাতে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং আগাছা বৃদ্ধি দমন করতে সাহায্য করতে পারে।

গ্ল্যাডিওলাস গাছের পরিচর্যা ও সার প্রয়োগ:

চারা বড় হবার ২৫- ৩২ দিন পর থেকে ২১ দিন অন্তর পরিমাণ মতো জল দিতে হবে। জল দেওয়ার পূর্বে মাটির সাথে অল্প পরিমানে ভিএপি/ টিএসপি, পটাশ এবং পরিমান মতো অনুখাদ্য (micronutrients) মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।

মাটি সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছগুলি সোজা রাখার জন্য কঞ্চি বা শক্ত লাঠি দিয়ে ঠেকনা দিতে হবে। গাছে জল দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে গোড়ায় জল না জমে। প্রতি ২০-২১ দিন অন্তর নিয়ম করে মাটি খুঁচিয়ে দিতে হবে।

গ্লাডিওলাস চাষে বেশি ইউরিয়া জাতীয় সার প্রয়োগ করা উচিত নয়। কারণ, এর ফলে ফুলের পুষ্পদন্ড বেশি লম্বা ও দূর্বল হয়ে যাবে, বাল্ব রোপণের ৩০ দিন পর থেকে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও মাটিকে পোকামাকড় মুক্ত রাখতে মাঝে মাঝে নিমখোল ব্যাবহার করবেন।

কীটপতঙ্গ এবং রোগ:

যদিও গ্ল্যাডিওলাস সাধারণত শক্ত, তারা কিছু কীটপতঙ্গ এবং রোগের জন্য সংবেদনশীল হতে পারে। এফিড, থ্রিপস এবং স্পাইডার মাইটের মতো সাধারণ বাগানের কীটপতঙ্গের জন্য নজর রাখুন। সংক্রমণের লক্ষণগুলির জন্য নিয়মিতভাবে পাতার নীচের অংশগুলি পরিদর্শন করুন।

বোট্রাইটিস এবং মরিচা সহ ছত্রাকজনিত রোগগুলি গ্ল্যাডিওলাসকে প্রভাবিত করতে পারে। এই সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করার জন্য, বায়ু সঞ্চালনের জন্য উদ্ভিদের মধ্যে পর্যাপ্ত ব্যবধান প্রদান করুন, মাথার উপরে জল দেওয়া এড়িয়ে চলুন এবং অবিলম্বে কোনও সংক্রামিত পাতা অপসারণ করুন।

গ্লাডিওলাস ফুল সংগ্রহ বা উত্তোলন:

সাধারণত গ্লাডিওলাস ফুলের বাল্ব লাগানোর ৭৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে গাছে ফুল ফোটে। গ্লাডিওলাস ফুল কাটার নিয়ম হলো যে দন্ডটিতে ফুল ও পাতা ধরে সেই দন্ডটি ফুলের অনেক নীচে থেকে কাটতে হয় এবং ফুল কাটার সাথে সাথে সেগুলোকে জলের মধ্য রাখতে হবে, তাতে করে ফুল শুকোবেনা।

গ্ল্যাডিওলাসের বংশবিস্তার ও বাল্ব সংরক্ষণ:

  • ১. বীজ, গুঁড়ি কন্দ ও গুঁড়ি কন্দের গায়ে জন্মানো ছোট ছোট গাছ থেকে গ্লাডিওলাসের বংশবিস্তার করা সম্ভব।
  • ২. বীজ থেকে চারা তৈরী করে সেই গাছে ফুল আসতে অনেক সময় লাগে এবং জাতিগত বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। তাই বীজ থেকে বংশবিস্তার করা উচিত নয়।
  • ৩. ফুল শেষ হলে গাছগুলি শুকিয়ে যায়। এ সময় মাটি খুঁড়ে গ্লাডিওলাসের কন্দ বা বাল্ব তুলে সংগ্রহ করতে হবে।
  • ৪. কন্দগুলোর গায়ে লেগে থাকা মাটি পরিষ্কার করে নিয়ে কন্দগুলো ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে শুকিয়ে নিতে হবে।
  • ৫. শুকানোর পর কন্দগুলো কিছুটা অন্ধকার শুকানো জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে পরবর্তী বছরের জন্য।
  • ৬. এগুলো সুপ্ত অবস্থা অতিক্রম করে গজানো শুরু করলে নতুন ফুল গাছের জন্য মাটিতে রোপণ করতে হবে।

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কাম্য করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *