Last updated on April 12th, 2024 at 09:31 pm
জাফরান একটি ফুলের উদ্ভিদ এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলাগুলির মধ্যে একটি , সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা হওয়া সত্ত্বেও এটি বিশ্বের যে কোনো জায়গায় জন্মাতে পারে। প্রাচীন যুগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরানের সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ জাফরান ব্যবহার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে ব্যাপক প্রচলন ছিল।
জাফরানের ইংরেজি নাম সাফরন (saffron)। জাফরান পৃথিবীর অন্যতম দামী মসলা গুলির মধ্য একটি। এটি ভারতে কেশর, বাংলাদেশে রেড গোল্ড নামেও পরিচিত। জাফরানের বৈজ্ঞানিক নাম Crocus sativas এটি Iridaceae পরিবার ভুক্ত।
কিভাবে আপনি জাফরান চাষ করবেন
জাফরান ফসলের আদিস্থান গ্রীস। ইউরোপিও ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই জাফরান চাষ প্রচলন আছে। আফগানিস্থান, ইরান, তুরস্ক, গ্রীস, মিশর, চীন এ সব দেশে কম বেশি জাফরানের চাষ হয়ে থাকে। স্পেন ও ভারতের হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীরে, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের মত রাজ্যগুলিতেও চাষ করা হয়। যেহেতু জাফরান চাষ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে, তাই জাফরান চাষের রোপণ কৌশলগুলি জলবায়ু, মাটির ধরন, রোপণের গভীরতা এবং কর্মের ব্যবধানের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ জাফরান স্পেন রপ্তানী করে থাকে। এখন এমন পরিস্থিতিতে অনেক প্রশ্ন কিভাবে জাফরান চাষ করা হয় ?
জাফরান গাছ লম্বায় প্রায় ৩০ সে.মিটার হয়। প্রতি ফুলে ৩টা স্ত্রী অঙ্গ (Stigma) থাকে, তবে তাতে পুরুষ অঙ্গ (Anther) থাকে মাত্র ৩টা। খাবার সু-স্বাদু করার জন্য বিশেষ করে বিরিয়ানী, কাচ্চী, জর্দা ও কালিয়াসহ নানা পদের দামী খাবার তৈরীতে জাফরান ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বিয়ের অনুষ্ঠানে জর্দা তৈরীতে প্রাকৃতিক আকর্ষণীয় রং আনতে এবং দামী বাহারী পান বিপণনে জাফরান অন্যতম উপাদান। মুখমন্ডল আকর্ষণীয় করতে ও ত্বকের উজ্জ্বল রং আনার জন্য স্বচ্ছল সচেতন রমণীরা প্রাচীন কাল থেকে জাফরান ব্যবহার করে থাকে। বিউটি পার্লারে রূপচর্চায় জাফরান অন্যতম উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
জাফরানে আছে ম্যাংগানিজ (Manganese), এন্টি ইনফ্লামেটরি( Anti-Inflammatory) এবং এন্টি ফাংগাল এজেন্ট (Antifungal agent) যা ব্লাড সুগার নিরাময় করে শরীরের প্রয়োজনীয় হরমোন বিকাশ করে।
জাফরান ক্রোকাসের জন্য স্থান নির্বাচন:
রোদ থেকে আংশিক ছায়ায় ভালভাবে নিষ্কাশন করা মাটিতে রোপণ করুন। নিশ্চিত করুন যে বাল্বগুলি প্রস্ফুটিত হওয়ার সময় সূর্যের আলো পাবে। যদি বাল্বগুলি স্যাঁতসেঁতে মাটিতে থাকে, যেমন কাদামাটি, সেগুলি পচে যেতে পারে।
জাফরান চাষের জন্য জমি প্রস্তুত:
প্রায় সব ধরনের জমিতে জাফরান ফলানো যায়। তবে বেলে-দোঁআশ মাটি এ ফসল চাষে বেশি উপযোগী। এঁটেল মাটিতে জাফরানের বাড় বাড়ন্ত ভাল হয় না, তবে এ ধরনের মাটিতে কিছু জৈব সার ও বালি মিশিয়েও মাটিকে উপযোগী করা যায়। মাটি, কম্পোস্ট ও বালির অনুপাত ২:২:১ করে দিতে হবে। তাছাড়াও দেশে চাষ উপযোগিতা আনতে জাফরান কন্দের ভার্নালাইজেশন করে নিতে হয় প্রথমেই। জলাবদ্ধ সহনশীলতা এ ফসলের একেবারেই নেই। এ জন্য পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি এ ফসল চাষের জন্য নির্বাচনে প্রাধান্য দেয়া প্রয়োজন। মাটির পি এইচ ৬-৮ হলে বেশি ভাল হয়। আলো এবং আংশিক ছায়ায় এ ফসল ভাল হয়। পর্যাপ্ত রোদ ও আলো-বাতাস প্রাপ্তি সুবিধা আছে এমন স্থান জাফরান চাষের জন্য নির্বাচন করাত হবে।
জাফরান চাষের জন্য বাল্ব সংগ্রহ:
প্রথমে জাফরান ক্রোকাস বাল্ব কেনার জন্য বিশ্বস্ত জায়গা সন্ধান করুন। বেশিরভাগ লোকেরা সেগুলি কেনার জন্য একটি নামকরা অনলাইন নার্সারিতে যান , যদিও আপনি সেগুলিকে একটি ছোট স্থানীয় নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন ৷ এটা খুব অসম্ভাব্য নয় যে আপনি তাদের একটি চেইন স্টোর বা বড় বক্স স্টোরে পাবেন।
একবার জাফরান ক্রোকাস বাল্ব কিনে ফেললে, আপনি সেগুলিকে আপনার উঠানে বা বড় ক্যারেটে লাগাতে পারেন। যেহেতু তারা পতিত-প্রস্ফুটিত ক্রোকাস, আপনি সেই বাল্ব গুলিকে শরৎকালে রোপণ করবেন, তবে আপনি যে বছর বাল্বগুলিকে রোপণ করবেন সম্ভবত সেই বছরে ফুল নাও আসতে পারে। পরবর্তী বসন্তে আপনি যখন ঝরা পাতা দেখতে পাবেন, যা আবার মরে যাবে এবং পরের শরৎকালে জাফরান ফুল ফুটবে। বাল্ব সংগ্রহ করবার সময়ে এক বছর বয়স্ক গাছের বাল্ব সংগ্রহ করবেন না।
জাফরান চাষের উপযুক্ত সময়:
জুলাই ও আগস্ট মাস জাফরান চাষের জন্য অনুকূল হিসেবে বিবেচিত হয়।জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়কে ফসল রোপণের উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হয়। জাফরান বীজ বপন বা রোপণের আগে মাটিকে চাষের উপযোগী করতে হবে। এতে জাফরানের ফলন বাড়ে।
উঁচু পাহাড়ি এলাকায় জাফরান লাগানোর উপযুক্ত সময় জুলাই থেকে আগস্ট। একই সময়ে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি এটির জন্য একটি ভাল সময় হিসাবে বিবেচিত হয়। সমভূমিতে, জাফরান বীজ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বপন করতে হবে।
পরিবারিক প্রয়োজন মেটাতে সাধারণত বাগানের এই ফসল চাষ প্রচলন হয়ে আসছে। অনেকে ছাদে বেড তৈরী করে অথবা টবে সীমিত জায়গায় জাফরান চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে থাকে। অনেকে এক মিটার চওড়া ও তিন মিটার লম্বা এবং ১৫ সে.মিটার উঁচু বীজতলা তৈরী করে নিয়ে তাতে জাফরান চাষ করে থাকে। এ ব্যবস্থায় পরিচর্যা গ্রহন ও ফুল থেকে স্টিগমা (গর্ভদন্ড) সংগ্রহ করা সুবিধা হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষের ক্ষেত্রে বীজতলার আকার লম্বায় ৮-১০ মিটার করা হয়।
কখন জাফরান ক্রোকাস ফুল ফোটার আশা করবেন:
বাল্ব প্রতিস্থাপনের ৬ থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে ফুল আশা করা যেতে পারে, যদিও কখনও কখনও তারা ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে ফুল ফোটে। ক্রোকাস পরিপক্ক অবস্থায় ৪” লম্বা হয়।
পরিচর্যা:
জাফরান চাষ করতে হলে সব সময় জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। মাঝে মাঝে কোন কিছুর দ্বারা হালকা ভাবে মাটি আলগা করে দিতে হবে, তাহলে মাটিতে বাতাস চলাচলের সুবিধা হবে এবং গাছ ভালোভাবে বাড়বে। শুকনো মৌসুমে হালকা সেচ দেয়া যাবে। তবে অন্য ফসলের তুলনায় সেচের প্রয়োজনীয়তা অনেক কম। বর্ষায়কালে জল যেন কোন মতেই জমিতে জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জল জমে থাকলে রোপিত বালব পঁচে যাবে। একবার ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে গেলে এবং পাতাগুলি হলুদ এবং বাদামী হয়ে গেলে, গাছের গোড়া পরিষ্কার করতে হবে। পাতায় আলতোভাবে টানুন, যদি এটি মাটি থেকে সহজে চলে আসে।
[ আরো দেখুন: লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা ]
[ আরো দেখুন: কিউই ফল গাছের প্রতিস্থাপন এবং সম্পূর্ন পরিচর্যা ]
আপদ ও রোগ বালাই:
এক প্রকারের ইঁদুর,খরগোস এবং শামুক জাফরানের পাতা, ফুল এমনকি গাছের মোথা খেতে পছন্দ করে, মোথা যত খায় নষ্ট করে তার দ্বিগুণ। এ জন্য এ ধরনের উপদ্রব দেখা গেলে প্রয়োজনীয় ফাঁদ ব্যবহার করে অথবা মারার জন্য ঔষুধ ব্যবহার করে তা দমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
গাছ ঢলে পড়া রোগ:
মাটিতে বসবাসকারী ছত্রাকের (পিথিয়াম, রাইজোক টোনিয়া) আক্রমণে গাছের গোড়া নরম হয়ে গাছ বাদামী রং ধারন করে তখনই গাছ হেলে পড়ে। প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে কার্বোন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাক নাশক স্প্রে করে সুফল পাওয়া যাবে।
শিকড় পচা রোগ:
শিকড় পচা রোগ দ্বারা জাফরান খুব ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ রোগের আক্রমণে শিকড় পঁচে গাছ মারা যায়। এ রোগ যথেষ্ট ছোঁয়াচে, এ জন্য বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করা দরকার এবং আক্রান্ত জমিতে দু-এক বছর জাফরান চাষ করা যাবে না। একই বাগানে ৩-৪ বছর ধরে জাফরান আবাদ অব্যাহত রাখা হলে এ রোগের উপদ্রব বাড়ে। এ জন্য তিন বছর ফসল নেয়ার পর চতুর্থ বছর মোথা উঠিয়ে নিয়ে নূতন ভাবে অন্য জমিতে এ ফসল চাষ ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তী ২ বছর এ রোগাক্রান্ত জমিতে আর জাফরান চাষ করা উচিত হবে না।
জাফরান সংগ্রহ:
রোপনের প্রথম বছর সাধারণত ফুল আসে না। তবে জাফরানের রোপিত বালব আকারে বেশ বড় হলে সে বছরই জাফরান গাছ থেকে মাত্র একটা ফুল ফুটতে পারে। পরের বছর প্রতি গাছে পর্যায়ক্রমে ২-৩ টা ফুল আসবে।