গোলাপ গাছের বিভিন্ন রোগ এবং তার প্রতিকার

Last updated on January 20th, 2024 at 11:24 pm

যারা শখে বাগান করেন বা ফুল ভালবাসেন, এমন কোন ব্যাক্তি নেই যে গোলাপ পছন্দ করে না। গোলাপ ছাড়া বাগান যেন অসম্পূর্ণ। কিন্তু গোলাপ গাছ প্রীতস্থাপনের কিছুদিন পর বাগানিরা গোলাপ গাছের বিভিন্ন ও পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হন। অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না, ঠিক কিভাবে গোলাপ গাছের পরিচর্যা এবং রোগ দমন করবেন।

আজকের প্রতিবেদন থেকে আপনারা গোলাপ গাছের বিভিন্ন রোগ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে সম্পূর্ন তথ্য জানতে পারবেন, যাতে গোলাপ গাছের বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় দমনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাগুলো সুনির্দিষ্ট সময়ে নিতে পারেন । গাছের রোগটি সঠিক ভাবে নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে সেটি যেমন আপনার গাছকে ভালো রাখবে অন্যদিকে আপনার পরিশ্রমও লাঘব করবে।

গোলাপ গাছের বিভিন্ন রোগ এবং তার প্রতিকার

গোলাপ গাছে অনেক রোগের মধ্য পাতায় কালো দাগ রোগ, ডাইব্যাক ও পাউডারি মিলডিউ উল্লেখযোগ্য এগুলি ছত্রাকজনিত ও খাদ্যের অভাব জনিত কারনে দেখা যায়। ছত্রাকজনিত রোগের লক্ষন ও প্রতিকার।

কালো দাগ পড়া রোগ:

ডিপ্লোকারপন রোসি (Diplocarpon rosae) নামক ছত্রাকের কারনে পত্রে এ রোগ দেখা যায়। রোগের বিস্তার পাতার পরিত্যক্ত অংশে জীবানু বেঁচে থাকতে পারে। রোগাক্রান্ত গাছের পাতায় গোলাকার কালো রঙের দাগ দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। আক্রান্ত গাছের পাতা ঝড়ে গিয়ে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায় এবং কালো দাগ কান্ডেও দেখা যায়। এপিল- আগস্ট (চৈত্র থেকে কার্তিক ) গরমের মাস পর্যন্ত এ রোগের আক্রমণ ঘটে। রোগাক্রান্ত গাছের পাতার উভয় পৃষ্ঠায় গোলাকার কাল রংয়ের দাগ পড়ে।

রোগের প্রতিকারঃ

  • গাছে সর্বদা সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • গাছের গোড়ায় যেন জল না জমে সেদিকে লক্ষ করতে হবে ।
  • বাতাস চলাচল এবং গোড়ায় সুর্যালোক প্রবেশের জন্য বছরে দুবার ডাল ছাটাই করতে হবে।
  • গাছের ডাল ছাটাই করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • গাছে রোগ দেখা দিলে কার্বেন্ডাজিম (যেমন-অটোস্টিন 50 WDG Carbendazim, সাফ WP, ম্যানসার 75 WP) প্রতি লিটার জলে ১.৫ গ্রাম হারে অথবা টেবুকোনাজল (যেমন-ফলিকুর ২৫০ ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। কার্বেন্ডাজিমের সিস্টেমিক ক্রিয়ার কারণে গাছের শিকড় ও সবুজ অংশ দ্বারা শোষিত হয়ে কোষ রসের মাধ্যমে সমস্ত অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ম্যানকোজেবের স্পর্শক ক্রিয়ার কারণে বাইরে থেকে ফসল রক্ষা করে। দ্বিমুখী ক্রিয়ার কারণে এগুলি ফসলকে খুবই ভালভাবে সুরক্ষা দেয় এবং সক্রিয় ভাবে গাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ডাইব্যাক:

ডাল কাঁটাই-ছাঁটাই করবার কিছুদিন পরে কাটা স্থানে এ রোগের আক্রমণ ঘটে। এ রোগের কারণে গাছের ডাল বা কাণ্ড মাথা থেকে কালো হয়ে নিচের দিকে মরতে থাকে। এ লক্ষণ ক্রমে কাণ্ডের মধ্য দিয়ে শিকড় পর্যন্ত পৌঁছে এবং সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। ডিপ্লোডিয়া রোসেরাম (Diplodia rosarum) এবং অনেক সময় কোলেটোট্রিকাম এসপি. (Colletorichum sp.) নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ বাহিত হয়।

পূরাতন বাগানে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখতে পাওয়া যায়। ছত্রাকটি গোলাপের পরিচর্যা বা ডাল ছাঁটার সময় সিকেচারের সাহায্য ছড়ায়। আর্দ্র আবহাওয়াতে প্রচুর পিকনিডিয়া ও স্পোর তৈরীর কারনে ডাইব্যাক ঘটে।

লক্ষন:

  • রোগাক্রান্ত গাছের ডাল আগা থেকে শুকাতে শুরু করে।
  • আক্রান্ত অংশ ধীরে ধীরে ক্রমশ: নীচের দিকে নামতে থাকে।
  • শুকানো অংশটা কালচে বা বাদামী রঙের পচা ছালযুক্ত হয়।
  • গোড়ায় পৌঁছালে পূরো গাছটি মরে যায়।
  • রোগাক্রান্ত গাছে কোন ধরনের কুঁড়ি ও ফুল হয় না।
  • গোলাপের ডগা শুকানো রোগের লক্ষণরোগের প্রতিকারঃ
  • আক্রান্ত ডাল কেটে পুড়ে ফেলতে হবে।
  • ডাল ছাঁটাই করবার সময়ে রোগাক্রান্ত অংশ কেটে বাদ দিতে হবে।

রোগের প্রতিকারঃ

  • ডাইব্যাক বা গোলাপের আগামরা রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত কাণ্ড বা ডালের বেশ নিচ থেকে কেটে পুড়ে ফেলতে হবে।
  • ডাল ছাঁটাইয়ের পূর্বে চাকু জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ডাল ছাঁটাই করা উচিত, এবং ডাল ছাঁটাইয়ের পরে কাটা স্থান ছত্রাকনাশক গাঢ় করে লাগিয়ে দিতে হবে।
  • কপার অক্সিক্লোরাইট জাতীয় ছত্রাক নাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি এক লিটার জলে সাত গ্রাম কুপ্রাভিট এর মিশ্রণ তৈরী করে গাছে সন্ধ্যায় স্প্রে করতে হবে।
  • গাছে নতুন পাতা আসলে ছত্রাকনাশক ব্যাভিস্টিন, সাফ , ম্যানসার এক থেকে দেড় গ্রাম/ লিটার জলে মিশিয়ে সাত দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

পাউডারি মিলডিউ:

এটি একটি ছত্রাক জনিত রোগ। শীতকালে প্রচন্ড কুয়াশার কারনে এ রোগে বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পাতা, কচিফুল ও কলিতে সাদা পাউডার দেখা যায়। ফলে কুঁড়িগুলি না ফুটে নষ্ট হয়ে যায়।

রোগের লক্ষণ:

  • গাছের পাতার উপর পিঠে ছোপ ছোপ সাদা পাউডারের আস্তরণ দেখা যায়। পরে সমস্ত পাতায় এই সাদা আস্তরণ ছড়িয়ে পড়ে।
  • পাতার বিকৃতি ঘটে। কচি ফুল ও কলিতেও সাদা রঙের পাউডারের মত লেগে থাকে। পরবর্তীতে সমস্ত গাছ আক্রান্ত হয়,ফলে পাতা ও ফুল ঝড়ে যায়।

রোগের প্রতিকারঃ

  • রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
  • আক্রান্ত পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলতে হবে।
  • রোগের প্রকোপ কম হলে দ্রুত বেগে পানি স্প্রে করেও দমন করা যায়।
  • এ রোগ দেখা মাত্র আক্রান্ত গাছের ডগা বা পাতা তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া যে কোন ছত্রাকনাশক বা সালফার ডাইথেন এম-৪৫ অথবা প্রোপিকোনাজোল (যেমন-টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ লিটার জলে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

ইয়োলো মোজাইক (Yellow mosaic):

ইয়োলো মোজাইক ভাইরাস (Yellow mosaic Virus) দ্বারা গোলাপ গাছ আক্রান্ত হয়ে থাকে। এটি উদ্ভিদে জীবানু ও সাদা মাছির মাধ্যমে ভাইরাস বাহিত হয়।

রোগের লক্ষণ:

  • যে কোন বয়সের গোলাপ গাছে এ রোগ হতে পারে, এটি পাতায় সবুজ এবং হলুদের মিশ্রন রূপে যায়। হলুদ দাগগুলি সাধারনত পাতার শিরা উপশিরা বরাবরও দেখা যায়। ইয়োলো মোজাইক রোগ মারাত্মক হলে সম্পূর্ন পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
  • রোগের কারনেআক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতি হয় এবং পাতাগুলো কুঁকড়ে যায়, গাছের ফুলও আকারে ছোট হয়।

রোগের প্রতিকার:

  • প্রথমত রোগমুক্ত চারাগাছ নার্সারী থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
  • রোগাক্রান্ত অংশ দেখা মাত্র তা কেটে ফেলতে হবে।
  • বাহক পোকা দমন করার জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড (অ্যাডমায়ার বা ইমিটাফ) ১ লিটার জলে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার দুপুরের পরে স্প্রে করতে হবে।

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কাম্য করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

4/5 - (1 vote)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *