Last updated on September 13th, 2022 at 01:01 pm
অ্যাডেনিয়াম আমাদের দেশের ফুল নয়। এটি বিদেশী ফুল, যার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার সাহারা, সুদান ও সেনেগাল মরুভূমি অঞ্চল। অ্যাডেনিয়াম(Adenium) ফুলের অনেক বৈচিত্র দেখতে পাওয়া যায়, যা ডেজার্ট রোজ নামেও খ্যাত। দীর্ঘদীন জল ছাড়া এই গাছ টবে বেঁচে থাকতে পারে। একটি নিদিষ্ট টবে দশ বিশ বছর রেখে দিলে তা স্বভাবগতভাবেই বনসাই গাছে রূপ নেয়।
আজকের এই প্রতিবেদন থেকে এডেনিয়াম গাছের ১২ মাস পরিচর্যা সম্পর্কে সম্পূর্ন তথ্য জানতে পারবেন। এডেনিয়াম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Adenium, ইংরেজি নাম -Desert rose (ডেজার্ট রোজ), এটি Apocynaceae (এপোক্যানাসেই) পরিবারের একটি গুল্ম জাতীয়, পর্ণমোচী, বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। বাংলায় বলা হয় মরু গোলাপ।
এডেনিয়াম গাছের ১২ মাস পরিচর্যা
এডেনিয়াম গাছের পরিচর্যা অন্যান্য গাছের তুলনায় খুবই সহজ ,আপনি চাইলেই আপনার বাড়ির ছাদে অথবা ঘরের বারান্দায় অথবা বাড়ির আঙ্গিনায় এই ফুলের চাষ করতে পারেন। এটি মরুভূমি অঞ্চলের গাছ হওয়াতে তেমন যত্নের প্রয়োজন হয় না| এই গাছ প্রচুর কষ্ট সহিষ্ণু ও অনেক দিন জল ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। এরা স্ফীত কান্ডে জল ও খাদ্য মজুত করে রাখতে পারে দির্ঘ দিন ধরে। কিছু কিছু প্রজাতির গাছে বিষাক্ত গ্লাইকোসাইড থাকে তাই এর আঠা ও পাতা মুখে না দেওয়াই ভাল। এই গাছ শীতের পর অর্থাৎ বসন্তের শুরু থেকে শরৎকাল ফুল দেয়। কিন্তু শীত পড়লেই তার ঘুমন্ত দশা(Rest Period) শুরু হয়,যাকে আমরা ডরমেন্সি পিরিয়ডও বলে থাকি । এই ফুলের প্রচুর ভ্যারাইটি ও প্রজাতির দেখতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন প্রজাতির এডেনিয়ামের মধ্য যেমনঃ- Obesum, Arabicum, MKMK, KHZ, KC, Tang Tong ইত্যাদি, এর মধ্যে আমরা ফুলের জন্য Obesum প্রজাতির এডেনিয়াম চাষ করে থাকি। আজ আমি এই প্রজাতির চাষ পদ্ধতিই আপনাদের কাছে তুলে ধরবো।
এডেনিয়াম গাছের উপযুক্ত জায়গা বা স্থান নির্বাচন :–
এডেনিয়াম খুব কড়া রোদ পছন্দ করে আর যেটা এর একেবারে পছন্দ করে না সেটা হল শীত বা ঠান্ডা। তাই যে জায়গায় একেবারে ঠান্ডা না আসে বা খুব কম আসে আর যেখানে কুয়াশা একেবারেই লাগবে না, তেমন রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় গাছগুলো রাখতে হবে। যদি গাছের সংখ্যা বেশি হয়,সরানো সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে প্রথমে সব গাছের পাতা কেটে যেকোন ফাংগিসাইড ১লিটার জলে গুলে ভালো করে ঝাঁকিয়ে স্প্রে করতে হবে। এরপর গাছগুলোকে সারিবদ্ধভাবে রেখে একটা বড় ত্রিপল বা প্লাস্টিক দিয়ে উঁচু করে ঢেকে দিতে হবে। এমনভাবে রাখতে হবে যেন কুয়াশা একদম না পড়ে আর কনকনে ঠান্ডাও যেন না আসে। রাতে এই জায়গায় যদি 100wএর বাল্ব লাগিয়ে রাখা সম্ভব হয় তবে সেটা গাছের জন্য খুব ভালো হবে, যেভাবে শীতকালে চন্দ্রমল্লিকা বা ডালিয়া গাছকে রাখতে হয় । ব্যালকনি বা বারান্দাতে ছোট গাছগুলো রাখা যেতে পারে।
এডেনিয়াম গাছের পাত্র নির্বাচন:–
এডেনিয়াম গাছের জন্য বড় কোন টব লাগে না। পাত্র যত ছোট হবে তত ভালো, তাই বলে একেবার ছোট পাত্র দেয়া যাবে না তাহলে গাছ উলটে যাবে। এডেনিয়াম গাছের জন্য মাঝারী গামলা জাতীয় মাটির টব নির্বাচন করা উচিত যেহেতু মাটিতে জল আটকে থাকবে না এজন্য এমন ধরনের পাত্র বেছে নিতে হবে যাতে সহজে জল ড্রেন হয়ে বেরিয়ে যায়। এজন্য অনেকে প্লাস্টিকের পটের চেয়ে মাটির পাত্র পছন্দ করেন, কেননা মাটির পাত্রে জল শোষন ক্ষমতা ভাল।
এডেনিয়াম গাছের মাটি প্রস্তুত :–
অ্যাডেনিয়ামের অপর নাম মরু গোলাপ যার অর্থ মরুভূমির গোলাপ, সুতরাং বুঝতে পেরেছেন মরুভূমির পরিবেশ অনুযায়ী এর মাটি ও সার সাজাতে হবে। যে মাটিতে জল জমতে না পাড়ে, মোটামুটি বাতাস চলাচল করতে পারে আবার হালকা জল ধরে রাখতে পারে এমন মাটি দরকার। অর্থাৎ বড় দানার বালুময় মাটি পেলে সব থেকে ভাল হয়। এছাড়াও আমাদের দেশে প্রায় সবধরনের মাটিতে অ্যাডেনিয়াম ফুলের চাষ করা যায়। তবে বেলে- দোঁয়াশ অথবা বেলে মাটিতে অ্যাডেনিয়াম ফুলের চাষ সবচাইতে ভাল হয়। এই ধরনের মাটিতে অ্যাডেনিয়াম ফুলের চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। মাটির সাথে বালি ও পাথর দিলে ভাল হয়।
✅ মাটি (SOIL) –25%
✅ বালি (Sand)–25%
✅ কম্পোস্ট (Compost)–25%
✅ এর টুকরা (ব্রিকস পিস)–25%
✅ হাড়ের গুড়ো –100 গ্রাম প্রতি গাছ
✅ শিংকুঁচি –100 গ্রাম প্রতি গাছ
✅ নিমখোল — ২৫ গ্রাম প্রতি গাছ
চারা গাছ প্রতিস্থাপনের এর জন্য দরকার একভাগ গার্ডেন সয়েল(দোঁয়াশ মাটি),একভাগ নদীর সাদা বালি ( বেলে-দোঁয়াশ মাটি ব্যাবহার করলে বালির প্রয়োজন নেই )ও একভাগ ভার্মিকম্পোস্ট বা এক বছরের পুরোনো পচানো গোবর সার বা পাতা পচা সার। এর সাথে আট/দশ/বারো ইঞ্চি টবের জন্য একভাগ ইট ভাঙা টুঁকরো, সাথে একমুঠো হাঁড়গুড়ো, একমুঠো শিংকুঁচি, হাফমুঠো নিমখোল মিশিয়ে নিতে হবে।
এডেনিয়াম গাছের জন্য আলো :-
গাছটি প্রতিস্থাপন হয়ে গেলে ৪ থেকে ৫ দিনের জন্য টবটি ছায়া স্থানে রেখে দিতে হবে। এক সপ্তাহ পর সকালের হালকা রোদে পায় তেমন স্থানে টবটি রাখতে হবে। তবে বর্ষাকালে প্রতিস্থাপন করলে ছায়া স্থানে রাখবার প্রয়োজন নেই। তবে অ্যাডেনিয়াম ঝলমলে সূর্যের আলো পছন্দ করে, তাই গাছ যত সূর্যের আলো পাবে তত ভালো ভাবে বেড়ে উঠতে পাড়বে এবং প্রচুর ফুল দেবে। তবে একদম ছায়াতে নয়। তাহলে কুঁড়ি ঝরে যাবে।
এডেনিয়াম গাছের জন্য সার প্রয়োগ:-
প্রতিস্থাপনের পরে পরিচর্যা
গাছটি প্রতিস্থাপনের কিছুদিন পর দেখবেন প্রচুর ডাল গজাতে শুরু করেছে। এই সময়ে জৈব সারের মধ্য গোবর সার/ পাতাপচা, সবজির খোসা ভেজানো জল বা সবজির খোসা থেকে তৈরী সার, ডিমের খোসা, কলার খোসা, হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি, হাঁফ চামচ সরষের খোল, Micronutrients, প্রভৃতি একত্রে মিশিয়ে ব্যাবহার করা যেতে পারে। প্রত্যেক মাসে একবার করে এটি ব্যাবহার করলে অন্য কোন সারের প্রয়োজন হবে না এতে গাছ সারা বছর সুস্থ এবং সতেজ থাকবে এবং গাছে ফুলের পরিমান অনেক গুন বৃদ্ধি পাবে।
শীত ও গরমের সময়ের পরিচর্যা
শীতকালে এই গাছের বিশেষ খাবারের প্রয়োজন হয় না, কারণ এই সময়ে গাছ ডরমেন্সি পিরিয়ডে থাকে। কিন্তু গরমের শুরু থেকে এদের খাবারের চাহিদা বেশি থাকে কারণ এ সময় গাছে প্রচুর কুঁড়ি আসতে শুরু করে। সঠিক যত্ন এবং পরিচর্যা করলে টানা শরৎকাল পর্যন্ত এই গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। গরমের মরসুমে এবং বর্ষার মরসুমে গাছ ভর্তি ফুল পেতে চাইলে প্রতি মাসে একবার করে অল্প পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে।
বেশি ফুল পেতে রাসায়নিক সারের ব্যাবহার
গাছ একটু বড় হলে NPK ১৯:১৯:১৯:/ ২০:২০:২০: সার ১ লিটার জলে ১ চামচ মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর দেবেন। ১ লিটার সার মিশ্রত জল ৩ টি গাছের জন্য। যার যেমন গাছ আছে সেই পরিমাণ মত দিবেন। NPK সার না পেলে তরল সার (খোল পচা জলের) সাথে DAP সার দিতে পারেন। গাছ একটু বড় হলে বেশি ফুল আনবার জন্য DAP ৮/১০ দানা প্রতি গাছে দিতে হবে ১৫ দিন পর পর,DAP দেওয়ার ১৫ দিন পর হাঁফ চামচ পটাশ ব্যাবহার করবেন। রাসায়নিক সার ব্যাবহারের ১৫- ২০ দিন পর যে কোন কম্পোস্ট সার মাটিতে দেওয়া যেতে পারে। মনে রাখবেন রাসায়নিক সার ব্যাবহার করলেও Micronutrients ব্যাবহার করা উচিৎ ।
[আরও পড়ুন: মিরাকুলান পি জি আর (ট্রায়াকন্টানল ০.০৫%) এর ব্যাবহার বিষদ জানতে ??]
অ্যাডেনিয়ামের বংশ বিস্তার :-
অ্যাডেনিয়াম গাছের চারা তৈরী করা হয় বা বংশবিস্তার ঘটানো হয় জোড় কলম বা বীজের মাধ্যমে। তবে বীজের গাছের মতৃগুনাগুন বজায় থাকে না, এর জন্য আপনাকে জোড় কলম পদ্ধতির মাধ্যমে চারা তৈরী করা উচিত। অ্যাডেনিয়াম গাছে অল্প পরিমাণ জল দিলেই যথেষ্ট। গাছ লাগানোর পর অল্প করে নিয়মিত জল দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে জল যেন বেশি না হয়ে যায়। জোড় কলম থেকে চারা তৈরীর আদর্শ সময় জুলাই থেকে আগষ্ট এবং ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ। এবং বীজ থেকে চারা তৈরীর আদর্শ সময় মার্চ মাস থেকে অক্টোবর।
অ্যাডেনিয়াম চাষ/ চারা রোপনের সঠিক সময় :-
বছরের যে কোন সময়ে আপনি অ্যাডেনিয়াম এর চারা প্রতিস্থাপন করতে পারেন। তবে গ্রীস্মকাল ও বর্ষাকালে চারা গাছ লাগানো সবচেয়ে উত্তম সময়।
অ্যাডেনিয়াম চাষ/ বীজ থেকে চারা তৈরীর সঠিক সময় :
বছরের অগাস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং মার্চ এপ্রিল মাসে আপনি অ্যাডেনিয়াম বীজ বসাতে পারেন । বীজ থেকে চারা গাছ তৈরী হতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগে।
অ্যাডেনিয়াম গাছের যত্ন ও পরিচর্যা :
অ্যাডেনিয়াম গাছ বাঁচতে পারে ৫০-৬০ বছর বা তারও বেশি। এ গাছের তেমন একটা বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। গাছ একটু বড় হলে গাছের আগা কেটে দিতে হবে, এই প্রক্রিয়টি আপনাকে ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে অথবা মার্চ মাসের মধ্য সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। তাহলে গাছে গরমের শুরুতে গাছে অনেক শাখা প্রশাখা বের হবে ও প্রচুর ফুল আসবে। গাছ একটু বড় হলে গাছকে একটি খুটির সঙ্গে বেধে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় যেন আগাছা না জন্মে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
[আরও পড়ুন: টবে বাগানবিলাসের পরিচর্যা ও বেশি ফুল পাওয়ার উপায় | Bougainvillea Care]
বর্ষাকালীন পরিচর্যা:-
বর্ষার মরসুমে অ্যাডেনিয়াম গাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে, সময় গাছের গোড়ায় প্রতি ১৫দিন অন্তর নিমখোল বা ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে এবং প্রয়োজনে টবের মাটি খুঁড়ে টব সমেত গাছটি রৌদে রাখতে হবে। এছাড়াও ১৫দিন অন্তর সমস্ত গাছে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
[আরও পড়ুন: এডেনিয়াম গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার কারণ এবং তার প্রতিকার ]
প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।
আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।
FAQ [Frequently Asked Questions]
এডেনিয়াম গাছ কতদিন বাঁচতে পারে ?
এডেনিয়াম একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, সঠিক পরিবেশ পেলে এবং পরিচর্যা করলে ৫০ থেকে ৬০ বছর বেঁচে থাকতে পারে।
এডেনিয়ামের চারা গাছ প্রতিস্থাপনের কতদিন পরে ফুল আসে ?
মরু গোলাপ বা এডেনিয়াম ধীর বর্ধনশীল উদ্ভিদ ,চারা গাছ প্রতিস্থাপনের দেড় থেকে দুই বছরের মাথায় ফুল আসে।
এডেনিয়াম কি সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে ?
এডেনিয়াম সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে, পরোক্ষ সূর্যালোক বা ছায়া স্থান পছন্দ করে না। যেহেতু অ্যাডেনিয়ামের আদি বাসস্থান মরুভূমি, তাই এডেনিয়ামকে সরাসরি সূর্যালোক বাঞ্ছনীয়, বিশেষ করে যখন তারা গ্রীষ্মের মাসগুলিতে তাদের সক্রিয় বৃদ্ধির পর্যায়ে থাকে।