Last updated on July 4th, 2024 at 02:03 pm
লন্ঠন জবাকে রেড টাইগার ও বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ল্যান্টার্ন হিবিসকাস। অসামান্য সুন্দর দেখতে এই লণ্ঠন জবা বছরের অধিকাংশ সময়ে বাগানকে আলো করে রাখবে। এমনিতেই আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জবার বৈচিত্র প্রচুর। অল্প যত্ন নিলেই এই গাছ ফুলে ভরে যায়। আসুন দেখে নেওয়া যাক টবে বা মাটিতে লন্ঠন জবার চাষ কি ভাবে করবেন।
লন্ঠন জবা গাছের পরিচর্যা | How to grow and care Lanthan jaba অনেক জবা প্রজাতির মধ্যে নতুন প্রজাতির জবা সম্পর্কে আজ আমরা জানবো। লন্ঠন জবা বা ঘন্টা জবার ইংরেজি নাম Lantern Hibiscus এবং বিজ্ঞানসম্মত নাম Abutilon Hibiscus। পৃথিবীতে অনেক ধরণের Hibiscus রয়েছে। Hibiscus বা জবা মূলত Malvaceae পরিবারে অর্ন্তভুক্ত।
বিবরণ ও পরিচিতি:
বাগানে সুন্দর আকৃতির দেখতে এই জবা ফুল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, বর্তমানে এই শোভাময় লণ্ঠন জবার জনপ্রিয়তার কারনে এর চাহিদা অনেক বেশি। বাংলাদেশে দুইটি প্রজাতি জবা খুবই জনপ্রিয়, একটি হল Hibiscus syriacus এবং আপরটি Hibiscus rosa-sinensis। এছাড়াও ভারতবর্ষে যেগুলিকে আমরা সাধারণত ব্যাঙ্গালোর জবা , পুনে ভ্যারাইটি , অস্ট্রেলিয়ান , তাহিতিয়ান সুপারনোভা হিবিশকাস (tahitian supernova hibiscus), তাহিতিয়ান লায়ন কুইন হিবিশকাস জবা (tahitian lion queen hibiscus)নামে চিনি সেগুলি Hibiscus rosa-sinensis প্রজাতির।
জবা সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডল এবং উপগ্রীষ্মমণ্ডলিয় অঞ্চলে খুব ভালো ভাবে বেড়ে ওঠে। ১০ ডিগ্রির নিচের তাপমাত্রা জবা গাছ সহ্য করতে পারে না। তবে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের গাছকে গ্রীনহাউসের মধ্যে রাখে চাষ করা হয়। লণ্ঠন জবা গাছ উচ্চতায় ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে, তবে এই গাছটি বেশি ঝোঁপ হয় না।
ঘণ্টা জবার এই প্রজাতি প্রায় সারাবছরই ফুল দেয়। শীত, বসন্ত ও গরমকালের শুরুর দিকে ফুল দেওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে তবে বর্ষাকালে এই প্রবণতা একটু একটু কমে যায়। গাছটি সরাসরি মাটিতে প্রতিস্থাপন করলে প্রথমেই এর জন্য মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবেl কিন্তু টবে করতে চাইলে সমস্ত গাছের মত এই গাছেরও তার পছন্দ অনুযায়ী মাটি তৈরী করে নিতে হবে, তা না হলে গাছের বৃদ্ধি থেমে যাবে এবং ফুলও আসবে না।
টব নির্বাচন:-
ঘণ্টা জবা একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ তাই ভালো হয় বড় গামলা জাতীয় টব নির্বাচন করলেI প্রথম অবস্থাতে চারা গাছটি ৮ ইঞ্চি টবে প্রতিস্থাপন করলেও এক থেকে দেড় বছর পারে ১০ ইঞ্চি অথবা ১২ ইঞ্চি টবে স্থানন্তিরিত করতে হবে। বড়ো পাত্র বা টব নিলেই যে প্রচুর ফুল হবে সে-রকম নয়, বড় টব নিলে এক থেকে দেড় বছর অন্তর গাছের শেঁকড় কাঁটাই- ছাঁটাই করতে হয়, তবে আপনি চাইলে বড়ো পাত্রও নিতে পারেন। টব নির্বাচন করবার সময় টবের তলানিতে এবং পাশে অবশ্যই যেন ছিদ্র থাকে, তা না হলে বাড়তি জল টবে জমে গাছটি মাড়া যেতে পারে।
মাটি প্রস্তুতি :-
ঘণ্টা জবার মাটি তৈরী করতে আমাদের লাগবে,একভাগ গার্ডেন সয়েল যেটা মূলত দোঁয়াশ মাটি-কেই বোঝানো হয়, একভাগ নদীর সাদা বালি(River sand),একভাগ ভার্মিকম্পোস্ট অথবা এক বছরের পুরোনো পচানো গোবর সার অথবা এক বছরের পচানো পাতাপচা সার। এগুলোর সাথে ৮ অথবা ১০ ইঞ্চি টবের জন্য চা চামচের হাফ চামচ ফসফেট, চা চামচের দু চামচ হাঁড়গুড়ো, দু চামচ শিংকুঁচি, এক চামচ নিম খোল খুব ভালো করে মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করতে হবে।
প্রতিস্থাপন পদ্ধতি :-
➧ প্রথমে টবের ছিদ্র গুলোকে ইটের টুকরো/ টব ভাঙা টুকরো দিয়ে আটকে দিতে হবে।
➧ ছিদ্র গুলোকে আটকে দেওয়ার পর কিছু বালি-নুড়ি টবের মধ্যে বিছিয়ে দিয়ে এক ইঞ্চি বেড তৈরি করতে হবে যাতে অতিরিক্ত জল ড্রেনেজ সিস্টেম থেকে টবের বাইরে বেরিয়ে যাবে।
➧টবের ড্রেনেজ সিস্টেম করার পর কিছু পরিমান মাটি টবের মধ্য দিয়ে একটি লেয়ার তৈরী করে দিতে হবে, তা হলে মাটির মধ্যে থাকা বাতাস বেরিয়ে যাবে ফলে গাছের শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
➧ এর পর টবে অল্প করে মাটি দিয়ে গাছটা টবের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে দিতে হবে।
➧তারপর যতটা মাটি প্রয়োজন ততটা মাটি টবে চেপে চেপে দিতে হবে। মাটি দেওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন টবের ওপর থেকে 2 ইঞ্চি ফাঁকা থাকে।
আলো:-
প্রতিস্থাপনের পর টবটি এক সপ্তাহ জন্য একটু ছায়াতে রেখে দিতে হবে। এক সপ্তাহ পর সকালের রোদ্দুর পায় এমন একটা জায়গায় টবটি রাখতে হবে। এই গাছ ব্যালকনিতে সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠে, যেখানে উজ্জ্বল আলো আসে সেখানে। ঘণ্টা জবা উজ্জ্বল আলোতে ভাল বেড়ে ওঠে তবে গরমকালে টবটি সেডের নিচে রাখতে হবে তা না হলে গাছের সমস্ত পাতা জ্বলে যাবে।
জল :-
গাছটি মাটিতে থাকলে বেশি জলের প্রয়োজন হয় না কিন্তু টবে থাকলে মাটি পরীক্ষা করে তবেই জল দিতে হবে। টবে জল জমলে গাছ মাড়া যেতে পারে, তাই এমনভাবে মাটি তৈরী করতে হবে যে মাটিতে কোন সময় জল দাড়াবে না। তবে এই গাছে অতিরিক্ত বৃষ্টির জল লাগলে মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে। বর্ষাকালে ১৫ দিন অন্তর ছত্রাকনাশক গাছে স্প্রে করবেন পাড়লে গাছের গোড়াতে কিছু পরিমান ছিঁটিয়ে দেবেন।
প্রয়োজনীয় খাদ্য :-
এই গাছে খুব সাবধানে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে ১০ ইঞ্চি টবের গাছের জন্য ১০ থেকে ১৫টি DAP/TSP দানা টবের সাইড দিয়ে দিতে হবে এবং DAP/TSP প্রয়োগের ১৫ থেকে ২০ দিন পরে হাফ চামচ পটাশ ব্যাবহার করতে হবে, এটি আপনারা গাছে কুঁড়ি তৈরী হবার আগে ব্যাবহার করবেনl তাছাড়া অন্যান্য সময়ে হাফ চামচ সুফলা গাছে ব্যাবহার করবেন। মনে রাখবেন গাছ তৈরী হয়ে যাবার পরে ৩০ থেকে ৪৫দিন অন্তর এক চামচ অনুখাদ্য ব্যাবহার করতে হবে।
তবে লন্ঠন জবা গাছের জন্য সব থেকে ভাল খাবার জৈব সার, এটির ব্যাবহারে গাছ বেশ দিন স্থায়ী হয়, গাছে ফুলের পরিমান বৃদ্ধি পায়, কুঁড়ি ঝড়া রোধ হয়, ম্যাগনেশিয়ামের অভাবে পাতা হলুদ হয়ে যায় সেটিও হবে না। ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি টবের গাছের জন্য দুমুঠো পরিমাণ জৈব সার সাথে হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি ,পাতাপচা সার, সরিষার খোল এবং অনুখাদ্য প্রভৃতি মিশিয়ে প্রতি দুমাস অন্তর ব্যাবহার করতে হবে। অনুখাদ্য গাছের জন্য একটি প্রয়োজনীয় উপাদান বিস্তারিত জানতে নিচের দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করুন।
[আরও পড়ুন: Micro Nutrients বা অনুখাদ্য গাছের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়]
রোগ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব :-
লন্ঠন জবা গাছে দয়ে পোঁকা বা মিলবাগের আক্রমন ঘটে, এছাড়াও পাতার নিচে মাকড়ের উপদ্রবও দেখতে পাওয়া যায়। উপসর্গ দেখা দিলে রাসায়নিক উপায়ে দমন করতে হবে। এছাড়াও লন্ঠন জবা গাছের একটি প্রধান অতি সমস্যা বৃষ্টিতে গাছের আগার কঁচি ডগাগুলি পঁচে যায়, এর জন্য ব্যাকটেরিয়া নাশক এবং ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। বিস্তারিত জানতে নিচে ভিডিওটি দেখতে অনুরোধ রইল।
[আরও পড়ুন: মিরাকুলান পি জি আর (ট্রায়াকন্টানল ০.০৫%) এর ব্যাবহার | Plant Growth Regulator]
FAQ [Frequently Asked Questions]
লন্ঠন জবা গাছ কি টবে করা সম্ভব?
লন্ঠন জবা টবে এবং মাটিতে খুব ভালভাবে বৃদ্ধি পায়। বড়ির বহিঃপ্রাঙ্গণ, সামনের বারান্দায় বা ব্যালকনীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে এটিকে টবে করা সম্ভব। লন্ঠন জবা গাছের জন্য বড় টব বাছাই করা ভীষন জরুরী। ১২ ইঞ্চি বা তার থেকে বড় টব নির্বাচন করলে ভাল হয়।
শীতের শুরুতে লন্ঠন জবা ডাল কাঁটাই করা উচিত ?
সারা বছর ধরেই কমবেশি গাছে ফুল ফোঁটে, লন্ঠন জবা গাছের ডাল গ্রীষ্মের শেষের দিকে বা শরতের শুরুতে হালকাভাবে ছাঁটাই করা যেতে পারে, তবে শরতের শেষের দিকে বা শীতকালে কোন ভাবে হিবিস্কাসের ডাল ছাঁটাই করা উচিত নয়।
কাটিং থেকে কি লন্ঠন জবা গাছের বংশবিস্তার করা সম্ভব?
হ্যা সম্ভব, শীতের শেষ গাছের পরিপক্ক ডালগুলি কেঁটে বেলে দোআঁশ মাটি বা মাটিহীন কোকোপিটের মধ্য বসিয়ে চারা গাছ তৈরী করা সম্ভব। তবে মাটিতে বা কোকোপিটের মধ্য বসানোর আগে রুটিং হরমোনের মতো অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন হবে। প্রতিটি কাটিং ২টি বা ৩ টি নোড সহ ৩ থেকে 8 ইঞ্চি লম্বা হওয়া উচিত।
প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।
আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।