লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা

একাঙ্গী একটি লাভজনক অর্থকারী ফসল। দেখতে আদার মতো, আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে, মাছের চার তৈরিতে, এবং সুগন্ধী তেল প্রস্তুত করতে একাঙ্গী ব্যাবহার হয়। একাঙ্গীতে বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ যেমন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট (Antioxidant) , অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল(Antimicrobial) রয়েছে।

আজকের প্রতিবেদন থেকে আপনারা সম্ভাবনাময় ফসল একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন,বর্তমান সময়ে একাঙ্গী রফতানি করার সম্ভাবনা বিশ্ব বাজারে অনেক বেশি। তাই প্রথাগত চাষ আবাদ যেমন: ধান, পাট, নানা রকমের সবজি চাষ না করে বিকল্প চাষ যেমন একাঙ্গী, কালো হলুদ, অশ্বগন্ধা, ব্রোকলি, ক্যাপসিকাম জাতীয় ফসল চাষ করতে হবে। কম খরচে বেশি মুনফা করতে একাঙ্গী ও অন্যান্য চাষে কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা:

একাঙ্গীর বৈজ্ঞানিক নাম Kaempferia galanga, এটি জিনজিবারেসি (Zingiberaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ আদা জাতীয় উদ্ভিদ। ভারত এবং বাংলাদেশে একাঙ্গী, ভুঁই চম্পা,সুরভি আদা, একানী বা চন্দ্রমূলি নামে পরিচিত। এর উৎপত্তিস্থল তাইওয়ান, চীন, কম্বোডিয়া এবং ভারত বলে মনে করা হয়। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষ করা হয়। বহুকাল ধরে একাঙ্গী থাই ও চাইনীজ রান্নাতে ব্যাবহৃত হয়ে আসছে।

পশ্চিমবঙ্গে নদিয়া জেলার তেহট্ট, করিমপুর ১-২ ব্লকে, রানাঘাট ১ ব্লকের বীরনগর, মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল, রানিনগর, হরিহরপাড়া, নওদা, লালবাগ ব্লকে, এছাড়াও দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, হুগলি, বীরভূম জেলাতে একাঙ্গী চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের মেহেরপুর, গোপালপুর, মাগুরায় মাগুরায় অঞ্চলে একাঙ্গী চাষ করে চাষীরা লাভবান হচ্ছেন।

একাঙ্গী চাষে তেমন খরচ নেই বললেই চলে, কন্দ রোপানের পূর্বে জৈব এবং রাসায়নিক সার দিয়ে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে। বছরে দুই থেকে তিন বার সেচ এবং মাঝেমাঝে কীটনাশক এবং ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করলেই হবে। ভাল মানের একাঙ্গী উৎপাদন করলে ১ বিঘা (২০ কাটা) তে সর্বাধিক ভারতীয় মুদ্রায় দেড় লক্ষ থেকে এক লক্ষ সত্তর হাজার আয় করা সম্ভব।

[ আরো দেখুন: লাভজনক একাঙ্গী চাষ পদ্ধতি, বিঘায় আয় দেড় লাখ টাকা ]

গাছের বৈশিষ্ঠ:

একাঙ্গী উদ্ভিদের পাতা পুরু, গাঢ় সবুজ বর্নের দেখতে অনেকটা কচুরিপানার ন্যায়। মাটি থেকে গাছের উচ্চতা ৪ সেন্টিমিটার। প্রতিটি থেকে একসঙ্গে ৯-১০টি পাতা বের হয়। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে প্রজাপতির ন্যায় সাদা রঙের ফুল ফোটে, শীত আসতে আসতে মাটির নীচের কন্দ বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাঘ, ফাল্গুনে পাতা সম্পূর্ন শুকিয়ে যায় ।

একাঙ্গী চাষের উপযুক্ত স্থান:

একাঙ্গী চাষের জন্য উঁচু জমি একদম আদর্শ। পূর্ন সূর্যের আলো সহ আংশিক ছায়াযুক্ত স্থান, যেখনে মাটি সর্বদা আদ্র থাকবে এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে। তবে জমিতে জল জমলে গাছ ছত্রাকের আক্রমনে মারা যায়। একাঙ্গী গাছ বৃদ্ধির জন্য প্রথমিক অবস্থায় প্রচুর খাবার লাগে, তাই রোপনের পূর্বে জমি তৈরী করে নিতে হবে। একই জমিতে পরপর দুইবার একাঙ্গী চাষ না করা ভালো।

শুকনো খড়খড়ে জমি যেমন: শাল, সেগুন টানের জমি একাঙ্গী চাষের উপযুক্ত নয়।

CreativityGardening

একাঙ্গী জাত:

একাঙ্গী জাতের মধ্য কস্তুরী, রজনী, চেকুর, মারাবা ইত্যাদি চাষ করা হয়।

একাঙ্গী চাষের জমি তৈরী :

  • উর্বর দোঁয়াশ, বেলে দোঁয়াশ এবং বেলে জাতীয় উঁচু জমিতে একাঙ্গী চাষ ভাল হয়। স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে নিচু জমিতে এর চাষ ভাল হয় না । জমির জল নিকাশি ব্যাবস্থা খুব ভাল থাকা প্রয়োজন। বর্ষার সময়ে জমিতে জল জমলে কন্দ পচে গিয়ে সমগ্র ফসল নষ্ট হতে পারে।
  • এছাড়াও শুকনো খড়খড়ে জমি যেমন: শাল, সেগুন প্রভৃতি টানের জমি একাঙ্গী চাষের উপযুক্ত নয়।
  • কন্দ প্রতিস্থাপনের অনন্ত এক মাস আগে জমি তৈরি করতে হবে। প্রথমে বিঘা প্রতি জমিতে এক কুইন্টাল গোবর সার ছিটিয়ে প্রথম সেচ দিয়ে দিতে হবে।
  • মাটিতে জো আসার পর দ্বিতীয় বার বিঘা প্রতি দুই বস্তা ফসফেট এবং এক বস্তা NPK ১০.২৬.২৬ (পরশ) এবং ৩০ কেজি চুন দিয়ে আড়াআড়ি চাষ দিতে হবে।
  • তৃতীয় চাষের পূর্বে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। মাটিবাহিত রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করবার জন্য শেষ চাষের আগে ব্যাকটেরিয়া নাশক সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স এবং কার্বোমিন দানা দিয়ে চাষ দিতে হবে। জমি জো হলে একাঙ্গী ভেঙে ঠুকরো ঠুকরো করে মাটির দুই ইঞ্চি গভীরে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

একাঙ্গী কন্দ বসানোর সময়:

চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস একাঙ্গী বসানোর উপযুক্ত সময়। গোটা কন্দ প্রথমে টুকরো টুকরো ভেঙে বা কেটে (আলুর মতো প্রায়) নিতে হবে, তারপরে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বনুয়ায়ী গোটা কন্দ বা টুকরো কন্দ মাটির দুই ইঞ্চি গভীরে প্রতিস্থাপন করতে হবে।

একাঙ্গী শোধন ও বিঘা প্রতি বীজের হার:

বিঘা প্রতি এক থেকে দেড়কুইন্টাল (১০০-১৫০ কেজি) কন্দ লাগে। প্রতিস্থাপনের পূর্বে অবশ্যই কন্দ শোধন করে নেওয়া উচিত। প্রতি লিটার জলে ৫ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি দিয়ে কন্দ দ্রবণে ৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। তার পর একদিনে ছায়ায় কন্দগুলি শুকিয়ে নিতে হবে।

একাঙ্গী প্রতিস্থাপন প্রদ্ধতি:

কন্দ বসানোর জন্য জমিতে ৮ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে ২ ইঞ্চি গভীর ভাবে পর পর লম্বা লাইন টানতে হবে, প্রতিটি স্থান থেকে প্রতিটির দূরত্ব ৮ ইঞ্চি হবে। কন্দ বসানোর পর প্রথম সেচ দিতে হবে। যতদিন না গাছ বার হচ্ছে ততদিন ১৫ দিন অন্তর মোট তিনবার সেচ দিতে হবে। প্রতিস্থাপনের ৪৫ দিন প্রযন্ত নিড়ানি না দিয়ে আগাছানাশক ব্যবহার করা যেতে পারে, ৯০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা যেতে পারে।

[ আরো দেখুন: কিউই ফল গাছের প্রতিস্থাপন এবং সম্পূর্ন পরিচর্যা ]

[ আরো দেখুন: জাফরান চাষ করে লক্ষ লক্ষ উপার্জন করতে পারবেন আপনিও ]

একাঙ্গী পরিচর্যা:

ফলন ভাল হলে বিঘায় ২০ থেকে ২৫ কুইন্টালর কাঁচা কন্দ পাওয়া যায়। শুকালে তা ওজনে দাঁড়ায় ৬০০ কেজি। বর্ষার সময়ে ছত্রাক দ্বারা একাঙ্গী গাছ আক্রান্ত হয়, এছাড়াও বীজ ও মাটি বাহিতর কারনে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ছত্রাকের কারনে গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায় পরবর্তী সময়ে গাছ মারা যায়। একাঙ্গীর ছত্রাক জনিত ধসা রোধে প্রতি লিটার জলে কার্বেন্ডাজিম ১২ শতাংশ এবং ম্যানকোজেব ৬৩ শতাংশ ডব্লুপি ২ গ্রাম গুলিয়ে শিঁশিড় শুকিয়ে যাওয়ার পরে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার জনিত কারনে গাছের গোড়ায় ও পাতায় জল বসা দাগ দেখা যায়।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *