টবে চেরি ফল গাছ যেভাবে প্রতিস্থাপন এবং পরিচর্যা করবেন

Last updated on November 17th, 2023 at 08:32 pm

চেরি গাছ দুটি কারণে মূল্যবান – একটি তাদের সুস্বাদু ফল এবং অপরটি তাদের অত্যাশ্চর্য ফুল। আপনি কোন প্রজাতির গাছ লাগাতে চান তা নির্ভর করে আপনাকে সেই গাছের উপযুক্ত মাটি প্রস্তুত করতে হবে।ফলের মধ্য চেরি অত্যন্ত জনপ্রিয়। চেরি দেখতে ছোট লাল বর্নের গোল আকৃতির, প্রতিটি ফলের ওজন ৫-৬ গ্রাম হয়, প্রজাতির উপর নির্ভর করে কখনো হালকা মিষ্টি ও হালকা টক অথচ খুবই সুস্বাদু হয়।

চেরি দুই ধরন হয়, একটি মিষ্টি (prunus avium) অপরটি টক (prunus cerasus)। যেগুলি মিষ্টি চেরি ফল যা অবিলম্বে গাছ থেকে তুলে খাওয়া যায় এবং টক চেরি বা বেকিং চেরি পাকলেও টক হয়। উভয় চেরি ফল গাছে তাড়াতাড়ি পাকে এবং বসন্তের শেষের দিকে ফল সংগ্রহ করা হয়। মিষ্টি চেরি ফুলের একটি পরাগায়নকারীর প্রয়োজন হয় কিন্তু টক চেরিগুলি প্রধানত স্ব-ফলদায়ক হয়। বুনো চেরি মাঠে চাষের অযোগ্য কারণ এই জাতের চেরির স্বাদ টক, তাই এগুলি রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয় ৷ এই দুটি জাতেরই উৎপত্তিস্থল ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়াতে ৷

টবে চেরি ফল গাছ যেভাবে প্রতিস্থাপন এবং পরিচর্যা করবেন

শীতের মরসুম থেকে গাছের পরিচর্যা শুরু করে দিতে হয়, কারণ বসন্তের সময় থেকে গাছে ফুল ফোঁটা শুরু হয় এবং গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে তাদের সুস্বাদু ফল পাঁকা শুরু হয়। মিষ্টি এবং টার্ট চেরি উভয়ই গাছের পরিচর্যা এবং ফসল কাটা সম্পূর্ন প্রদ্ধতি এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে।

মিষ্টি চেরিগুলি প্রায়শই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। মিষ্টি চেরিগুলি পুরু আবরণ, সমৃদ্ধ, এবং প্রায় বরই মত টেক্সচার আছে। এগুলি স্ব-জীবাণুমুক্ত এবং একটি বাগান বা বড় বাগানের জন্য সেরা। ফলনের জন্য কমপক্ষে দুই বা তিনটি গাছের প্রয়োজন হবে, কারণ তাদের একে অপরকে পরাগায়ন করতে হবে। স্থান সীমিত হলে, বামন, স্ব-পরাগায়নকারী জাত ‘স্টেলা’ বিবেচনা করতে হবে।

টক চেরি সাধারণত কাঁচা খাওয়া হয় না, তবে সংরক্ষণ এবং অন্যান্য রান্নার ব্যবহারের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। টক চেরি মিষ্টি চেরি থেকে অনেক ছোট এবং সমস্ত জাত স্ব-উর্বর। তারা 4 থেকে 6 অঞ্চলে বৃদ্ধি পায়।

টবে চেরি ফল গাছ যেভাবে প্রতিস্থাপন এবং পরিচর্যা করবেন

চেরি গাছের জন্য মাটি প্রস্তুত এবং স্থান নির্বাচন:

কোন ধরষের ফসল চাষ করবার জন্য উর্বর মাটি প্রয়োজন, চেরি ফল চাষ তার ব্যাতিক্রম নয়। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বায়ু সঞ্চালনের উপযোগী সহ রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় চেরি গাছ প্রতিস্থাপন করা উচিত; বড় গাছ বা বাড়ির সাথে রোপণ করা এড়িয়ে চলুন যা চেরি গাছকে ছায়া দেবে। আদর্শভাবে, চেরি গাছের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ ঘন্টা সূর্যালোক পায় এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত। তবে স্যাঁতস্যাতে মাটি চেরি ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। ৬ থেকে ৭.০ এর মধ্যে নিরপেক্ষ pH সহ সুনিষ্কাশিত উর্বর সমতল অথবা মাঝারি উচুঁ স্থানে চেরি ভাল বৃদ্ধি পায়। চেরি ফল গাছ জলবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।

চেরি গাছ রোপণের পূর্বে, জৈব পদার্থ যেমন কম্পোস্ট বা গোবর সার অন্তর্ভুক্ত করে মাটি প্রস্তুত করতে হবে যাতে নিষ্কাশনের উন্নতি হয়। টবে গাছ করবার জন্য মাটি সর্বদা আর্দ্র রাখতে হবে, ভেজা নয়, এবং মাটি কখনই শুকাতে দেওয়া উচিত নয়। একটি সুষম সার শীতের পর এবং গ্রীষ্মে প্রতি মাসে প্রয়োগ করা উচিত। টবে গাছ করবার জন্য বিশেষ ধরণের মাটি তৈরি করতে হবে,৫০ শতাংশ দোআঁশ মাটি, ২০ শতাংশ কোকোপিট, ৩০ শতাংশ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট নিতে হবে, সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে এক চামচ নিমখোল, দু চামচ হাড়গুঁড়ো, দু চামচ শিংকুঁচি ভালো করে মিশিয়ে চেরি গাছ প্রতিস্থাপন করতে হবে।

যেভাবে চেরি গাছ লাগাবেন:

চেরি গাছের চারা রোপণের সর্বোত্তম সময় হল শরৎ কাল এবং বসন্তের প্রথম দিকে। পাত্রে গাছ করবার জন্য, টবের গর্তটি টবের চেয়ে তিনগুণ প্রশস্ত হওয়া উচিত। এরজন্য ১২ ইঞ্চি অথবা বড় এবং গভীর পাত্র নির্বাচন করবেন। কলমের চারা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রাফ্ট মোড়ের দিকে আপনার নজর রাখুন যাতে এটি শেষ মাটির স্তর থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে থাকে। চেরি বীজ থেকে তৈরী গাছ রোপণ করবে না।

টবে চেরি ফল গাছ যেভাবে প্রতিস্থাপন এবং পরিচর্যা করবেন

টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রাখবার জন্য টবে ছিদ্র আছে কি না তা নিশ্চিৎ করতে হবে, টব নির্বাচন হয়ে গেলে টবের নিচে খোরাম কুঁচি বা টব ভাঙার টুকরো দিয়ে প্রথমে ছিদ্র বন্ধ করে দিতে হবে। এর পর মাটি দিয়ে পাত্র অর্ধেক ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে মাটি চেপে দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।

চেরি ফল গাছের জন্য উপর্যুক্ত তাপমাত্রা:

চেরি গাছ যেকোনো তাপমাত্রায় বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি ৩০-৩৫ ‍ডিগ্রী তাপমাত্রায় চেরি ফল উৎপাদন করা সম্ভব। তবে ফুল আসার সময়ে আদর্শ তাপমাত্রা ১৬ থেকে ২২ডিগ্রী সেলসিয়াস মধ্য উপযোগী

চেরি ফল গাছ চাষের সময়:

চেরি ফল শীত বা বসন্ত কালে ধরে। চেরি ফল গাছ মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে অথবা বর্ষার শেষে অথবা শরৎকালে রোপন করা উচিৎ। চেরি ফল গাছ বড় হতে কমপক্ষে ২-৩ বছর সময় লাগে। তবে বর্ষাকালে অথবা এর আগেও চেরি ফল গাছ প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। কারণ, বর্ষাকালে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল থাকে এবং জমির মাটি স্যাঁতস্যাতে থাকে, যা চেরি ফল গাছ প্রতিস্থাপনের জন্য উপর্যুক্ত।

চেরি ফল গাছে জল প্রয়োগ:

টবে চেরি গাছ প্রতিস্থাপন করলে বর্ষা এবং শীতে জলের চাহিদা কম থাকে। কিন্তু গরমের সময়ে জলের চাহিদা প্রচুর থাকে । এজন্য গরমকালে সকালে এবং বিকেলে মাটি ঠান্ডা হয়ে যাবার পর প্রতিদিন দুবেলা করে গাছের গোড়ায় জল দিতে হবে। গরমকালে over watering হলেও কোন সমস্যা নেই। এই গাছ কষ্টসহিষ্ণু, অতিরিক্ত রোদ সে সহ্য করতে পারে, তবুও সন্ধাতে স্নান করিয়ে দিলে গাছের স্বাস্থ্য বজায় থাকে।

সূর্যের আলো:

চেরি গাছের জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে৭ ঘন্টা সূর্যালোক পায় এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত। তাই আপনি নিশ্চিত হন যে চেরি গাছ অন্য গাছের ছায়ায় যেখানে বেড়ে উঠবে সেখানে রোপণ করবেন না।

ছাঁটাই:

টবে চেরি গাছের আকার দিতে এবং আলো ও বায়ু সঞ্চালনের জন্য ছাঁটাই প্রয়োজন। চেরি ছাঁটাইয়ের সময় শীতের শেষের দিকে এখন গাছসুপ্তাবস্থায় থাকে। সূর্যালোক এবং বাতাসের অনুমতি দিয়ে কেন্দ্রটি খোলার জন্য গাছের ছাউনিটি আবার ছাঁটাই করুন। প্রয়োজনে একই সময় রি-পটিং-ও করতে পারেন। এই গাছ বেশ কষ্টসহিষ্ণু গাছ, হার্ডপ্রুনিং এবং রি-পটিং দুটো একসঙ্গে করলেও এর কোন অসুবিধে হয় না।

[আরও পড়ুন: কিউই ফল গাছের প্রতিস্থাপন এবং সম্পূর্ন পরিচর্যা | How to grow & care kiwi fruit plant]

চেরি গাছের বিশেষ যত্ন:

  • টক এবং মিষ্টি চেরি গাছের মধ্যে যত্ন মধ্যে কোন পার্থক্য নেই.
  • গ্রীষ্মকালে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে গাছের গোড়ায় মালচ ব্যাবহার করতে হবে , তবে কাণ্ডের চারপাশে কয়েক ইঞ্চি খালি মাটি ছেড়ে দিন।
  • ফলের সময়ে পাখির হাত থেকে ফল রক্ষার জন্য গাছে জাল লাগাতে হবে।
  • গ্রীস্ম কালে বা শুষ্ক এলাকায় নিয়মিত গাছে জল দিতে হবে।
  • চেরি গাছের জন্য ফল পাতলা করার প্রয়োজন নেই, কারণ গ্রীষ্মের শুরুতে তারা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে পাতলা হয়ে যায়।
  • নতুন ফলদায়ক গাছের বৃদ্ধিকে উত্সাহিত করার জন্য প্রতি বছর শীতের মাঝামাঝি সময় গাছের ডাল ছাঁটতে হবে। শরৎকালে ডাল ছাঁটাই করবেন না।
  • বসন্তের শুরুতে কম নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার(যেমন NPK- 5-10-10) গাছে ফুল ফোটার কয়েক সপ্তাহ আগে প্রয়োগ করতে হবে, তারপর চেরি কাটা না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সার দিতে হবে । গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে সার দেবেন না, কারণ নতুন বৃদ্ধির জন্য শরৎ এবং শীতের আগে শক্ত হতে সময় প্রয়োজন।

[আরও পড়ুন: ড্রাগন ফল গাছের সম্পূর্ণ চাষ পদ্ধতি]

চেরি গাছের রোগ:

কোকোমাইকোসিস চেরি গাছের সাধারণ ছত্রাকজনিত রোগগুলির মধ্যে একটি। এটি চারা গাছ এবং পরিপক্ক উভয় গাছকে প্রভাবিত করে। চেরি গাছের পাতায় বাদামী দাগ দ্বারা এর চেহারা সম্পর্কে ঝুঝতে পারেন। পাতার নীচের অংশ সাদা বৃদ্ধি দ্বারা আবৃত। এই রোগ খুব দ্রুত ছড়ায়। সময়মতো রোগের লক্ষণ দেখা না গেলে শীঘ্রই পুরো বাগান সংক্রমিত হয়। এটি পরিত্রাণ পেতে, সঠিক সময়ে ব্যাবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।

মনিলিওসিস রোগটি কেবল চেরি নয়, বাগানের নাশপাতি, ডালিম এবং অন্যান্য গাছকেও প্রভাবিত করে। অতএব, এটি বিশেষভাবে সক্রিয়ভাবে লড়াই করা প্রয়োজন। মনিলিওসিস রোগ দ্বারা গাছের শাখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাতাগুলি দেখে মনে হচ্ছে তারা খারাপভাবে পুড়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে, চেরির কাণ্ড ফাটতে শুরু করে। গাছে প্রদর্শিত ফলগুলি অবিলম্বে পচতে শুরু করে। কোকোমাইকোসিসের ক্ষেত্রে, বোর্দো তরল রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ব্যবহৃত হয়। বসন্ত ও গ্রীষ্মে আক্রান্ত পাতা ও শাখা সাবধানে কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

ফাটল রোগ ফল গুলিকে ভীষন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এর প্রভাবে চেরিগুলিতে গভীর ফাটল দেখা দেয়। আঠা সাধারণত তাদের থেকে প্রবাহিত হয়। এই সমস্যাটি ছোট মনে হতে পারে। তবে এটি গাছের ফলন হ্রাসের পাশাপাশি এর বৃদ্ধিতে ধীরগতির দিকে নিয়ে যায়।ফাটল মোকাবেলায় সমাধান পেতে দ্রুত ব্যাবস্থাপনা গ্রহন করতে হবে।

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *