চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা | Tecoma Plant Care

Last updated on November 13th, 2023 at 08:44 pm

চন্দ্রপ্রভা হল একটি বহুবর্ষজীবী ফুলের উদ্ভিদ যা লতানো বা ঝোঁপের ন্যায়ও হতে পারে (Trumpet vine) পরিবার Bignoniaceae থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল রঙের ফুলের জন্য পরিচিত। টেকোমা গাছগুলি তাদের ট্রাম্পেট আকৃতির, রঙিন ফুল এবং সবুজ পাতার জন্য বিখ্যাত। ভারতবর্ষ সহ বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাতে গ্রীষ্মকাল থেকে শুরু করে শরৎকাল পর্যন্ত এই গাছে প্রচুর পরিমাণে ফুল ফোঁটে, গাছের ডালের প্রতিটি আগাতে গুচ্ছ আকারে Red, Yellow, Orange, Pink, White প্রভৃতি রঙের ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছের অনেক গুলি প্রজাতি রয়েছে তারই মধ্যে আজ আমি আলোচনা করবো চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা (Yellow Bells, Yellow Elder, Esperanza, Yellow Trumpetbush) গাছের প্রতিস্থাপন এবং পরিচর্যা নিয়ে আলোচনা করব।

হলুদ টেকোমা বা চন্দ্রপ্রভা চিরসবুজ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এটি দেখতে ঝোপালো আকৃতির হয়। সাধারণত চন্দ্রপ্রভা গাছ চার মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে পারে। তবে আলো-বাতাসের প্রাপ্যতা, মাটির গুণাগুণ ও স্থানভেদে এর কম বা বেশিও হতে পারে। এই বৃক্ষের মাথা কিছুটা ছড়ানো থাকে। পাতা সবুজ ও কিনার খাঁজকাটা থাকে। গাছের ডালের আগাতে থোকায় থোকায় হলুদ রঙের ফুল ফোটে। হলদে চন্দ্রপ্রভা বা সোনাপাতি (বৈজ্ঞানিক নাম: Tecoma stans) (ইংরেজি: Yellow bells, Yellow trumpet, Yellow Trumpetbush বা Yellow-Elder) হচ্ছে বিগ্নোনিয়াসি পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ।

চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা | Tecoma Plant Care

টেকোমা উদ্ভিদের প্রজাতি:

Bignoniaceae পরিবারের অন্তর্গত Tecoma উদ্ভিদ বিভিন্ন প্রজাতিতে আসে, যার প্রত্যেকটিরই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিছু জনপ্রিয় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে:

Tecoma stans: এই প্রজাতি গাছগুলি সাধারণত হলুদ টেকোমা (Yellow Bells) নামে পরিচিত, আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল হলুদ রঙের ফুলের জন্য পরিচিত। এটি প্রতিস্থাপনের জন্য বড় পাত্র অথবা বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়, আপনার বাগানে রঙের স্প্ল্যাশ যোগ করার জন্য হলুদ টেকোমা উপযুক্ত।

Tecoma capensis: এটি কেপ হানিসাকল নামেও পরিচিত, এই প্রজাতির ফুলগুলি কমলা বর্ণের হয় যা কমলা টেকোমা নামে পরিচিত, নলাকার ফুল এবং চিরহরিৎ পাতার জন্য বিখ্যাত।

Tecoma alata: এই প্রজাতির ফুলগুলি জ্বলন্ত লাল-কমলা রঙের সাথে আসে, যা আপনার বাগানের জন্য আরেকটি নজরকাড়া বিকল্প। এই প্রজাতির ফুলগুলি কমলা বা লাল টেকোমা নামে পরিচিত।

হলুদ টেকোমা (Yellow Bells) গাছগুলির আকর্ষণীয় চেহারা এবং হলুদ ফুলের জন্য জনপ্রিয়, কিন্তু তার উচ্চ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নয়। হলুদ টেকোমা খরা, তাপ এবং ঠান্ডা সহনশীল। এই গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ এবং বাগানের সুন্দর্যের জন্য দুর্দান্ত পছন্দ, এমনকি এটি বড় পাত্রে বা বাগানের একটি স্থানে সহজে জন্মানো যেতে পারে।

চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা গাছের সম্পূর্ন পরিচর্যা

গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য খোলা আকাশের নীচে প্রতিস্থাপন করতে হবে, যেখানে কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সূর্যের আলো পায় এবং পাতলা শাখাগুলি এবং ফুলগুলি যাতে বাতাসের দ্বারা ক্ষতিগ্রন্থ না হয় তার জন্য এমন জায়গায় রাখার চেষ্টা করুন যেখানে তারা উচ্চ বাতাস থেকে আশ্রয় পাবে। হলুদ ঘণ্টা বা হলুদ টেকোমা কোন ধরনের রোগ বা কীটপতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত হয় না, যদিও স্কেল এই গুল্মকে প্রভাবিত করতে পারে।

হলুদ টেকোমা গাছে বছরে দুই থেকে তিনবার ফুল ধরে । হলুদ টেকোমা বা হলুদ চন্দ্রপ্রভা খরা সহনশীল এবং উষ্ণ জলবায়ুতেও ভাল জন্মে। এর ফুলগুলি মৌমাছি, প্রজাপতি এবং হামিংবার্ড সহ ছোট পাখিদের আকর্ষণ করে মধু সংগ্রহের জন্য। এই গাছের বীজ পাখির মাধ্যমে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষে হলুদ টেকোমা গ্রীষ্ম-বর্ষা ও শরৎ-হেমন্তে ফুটলেও কিছু কিছু গাছে বছরের অন্যান্য সময়েও দু’একটি ফুল ফুটতে দেখা যায়। এই দ্রুত বৃদ্ধিপায়।

স্থান নির্বাচন:-

হলুদ টেকোমা রৌদ ভীষন পছন্দ করে, দিনে ৬ থেকে ৮ ঘটা সূর্যের আলো পাই তেমন স্থানে গাছ প্রতিস্থাপন করা উচিত, এতে গাছের বাড়বাড়ন্ত ভালো হয় এবং রোগে আক্রান্ত কম হয়। গাছটিকে মাটিতে প্রতিস্থাপন করবার কিছু মাস পরেই ফুল আসা শুরু হয়। ‘টেকোমা’ সুনিষ্কাশিত যে কোনো ধরনের মাটিতেই ভাল হয়, তবে খেঁয়াল রাখাতে হবে গরমকালে গাছের মাটি যেন শুঁকিয়ে না যায়। গাছটি যদি টবে প্রতিস্থাপন করতে চান, তাহলে গাছটির চাহিদা অনুযায়ী খাবার,আলো,জল, কীটনাশাক এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি খেয়াল করতে হবেI আর সেই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা নিম্নে বর্ণিত হলো।

পরিচর্যা:

হলুদ টেকোমা গাছে প্রচুর ফুল পেতে চাইলে প্রতি মাসে একবার করে টবে সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যকীয়।  সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে জৈব সার : শুকনো গোবর সার, পাতা পঁচা সার অথবা ভার্মিকম্পোষ্ট ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেহেতু টেকোমা গাছে সারা বছর ফুল দেয়, তাই গাছে খাবারের পরিমানও বেশি প্রয়োজন হয়। প্রত্যক মাসে প্রতি টবের ক্ষেত্রে দুমুঠো গোবরসার অথবা পাতা পাঁচা সার  অথবা ভার্মি কম্পোস্ট দিতে হবে ,একমুঠো হাড়গুড়ো ,একমুঠো শিং কুচি ,এক চামচ নিমখাল,এক চামচ আবদাগোল্ড এবং এক চামচ বাদাম খোল একসাথে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এবং প্রতি ৪৫দিন অন্তর একবার অনুখাদ্য দিতে হবে।

গরমের সময়ে (মার্চ- জুন মাস) কোন খোল জল বা সরিষার গুড়ো খোল দেবেন না। গরম কমে গেলে সরিষার গুড়ো খোল ব্যাবহার করতে পারেন তবে গাছে ফুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে। যখন দেখবেন গাছের প্রতি ডালে কুঁড়ি আসতে শুরু করছে তখন সরিষার খোল জলের সাথে DAP/TSP মিশিয়ে ব্যাবহার করতে হবে। গাছে জৈব সার ব্যাবহার করবার পাশাপাশি খোল জলের সাথে DAP/TSP ব্যাবহার করা যায়, জৈব সার ব্যাবহার করবার ১৫ থেকে ২০দিন পর যে কোন রাসায়নিক সার ব্যাবহার করা যায়। প্রতিমাসে একবার করে গাছে পটাশ ব্যাবহার করবেন। কুঁড়ি আশা শুরু হলেই নিয়মিত গাছে জল দিতে হবে।

রাসায়নিক সারের মধ্যে  টিএসপি / ডিএপি এবং এমওপি  সার মিলিয়ে এক চা চামচ পরিমাণ সার জলের সাথে মিশিয়ে টবের চারদিকে দিতে হবে। গাছে ফুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এক চামচ ইউরিয়া ব্যাবহার করতে পারেন। ফুল আসার আগের মুহূর্তে গাছের নতুন ভাবে পরিচর্যা শুরু করতে হবে, প্রথম পর্যায়ে নিম খোলের গুড়ো ও ফসফেট মিশিয়ে অল্প পরিমাণে গাছের টবে বা মাটির চারদিকে দিয়ে দিন। এর পরে যেভাবে পরিচর্যা করতে বলা হল, তা অনুসরণ করুন।

[আরও পড়ুন: ঝিন্টি গাছে প্রচুর ফুল পেতে কি ভাবে পরিচর্যা করবেন]

গাছের মাটি পরিবর্তন:

টবে গাছ প্রতিস্থাপন করলে প্রতি এক থেকে দেড় বছর অন্তর টবের মাটি পরিবর্তন করতে হবে। এই গাছের মাটি পরিবর্তন এবং পিনচিং করবার নির্দিষ্ট কোন সময় নেয়। কমপক্ষে বছরে একবার গাছ রিপটি বা মাটি বদলে দিলে গাছ ভাল থাকবে এবং গাছে সময় মতো ফুলও আসবে, রিপটিং এর সময়ে গাছের ৭৫% শিকড় রেখে বাকি ২৫% শিকড় ছেটে দিতে হবে। এবং বর্ষা শেষ হবার পর গাছের মোটা ডাল গুলি ছেটে দিতে হবে।

পিনচিং:

টবের গাছের সুন্দর্য আনার জন্য পিনচিং ভীষণ প্রয়োজন। যে কোন গাছের সুন্দর্য তার শেপের ওপরই নির্ভর করে, তাই টবে গাছ বাড় নেয়া শুরু করলেই নতুন ডাল ছয় সাত ইঞ্চি হলেই ওর মাথা পিনচিং করে দিতে হবে। এতে গাছ ঝাঁকড়া হবে এবং ফুলের পরিমান বৃদ্ধি পাবে।

রোগব্যাধি:

অন্যান্য গাছের তুলনায় চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা গাছে তেমন একটা রোগব্যাধি লক্ষ করা যায় না বললেই চলে। তবে ভালো গাছ করতে হলে ১৫ দিনে একবার যেকোন কীটনাশক স্প্রে করতে হবে এবং বর্ষাকালে ১৫ দিনে একবার যেকোন ফাঙ্গিসাইড স্প্রে করতে হবে।

[আরও পড়ুন: নীলমণি লতা গাছের সম্পূর্ণ পরিচর্যা | Easy to Grow & Care Petrea Volubilis]

চন্দ্রপ্রভা বা সোনাপাতি দেশি নামে পরিচিত হলেও এই ফুলের আদি নিবাস আমেরিকা। চন্দ্রপ্রভা যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন আইল্যান্ডের অফিশিয়াল ফুল। আটলান্টিক মহাসাগরের ওয়েস্ট ইন্ডিজের লুকায়ান দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত বাহামার অঞ্চলের জাতীয় ফুল ইয়েলো এলডার বা হলুদ টেকোমা অথবা চন্দ্রপ্রভা। এই সব অঞ্চলে সমস্ত মৌসুমজুড়ে থোকায় থোকায় ফুল দেখতে পাওয়া যায়। এই কারণে ইয়েলো এলডার বা হলুদ টেকোমা ফুল সেই দেশটির জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে।

চন্দ্রপ্রভা বা হলুদ টেকোমা ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে গ্রীষ্ম-বর্ষা এবং শরৎ- শীত দীর্ঘ সময় ধরে গাছে ফুল দেখতে পাওয়া যায়, তবে কিছু কিছু গাছে প্রায় সারা বছরই কম-বেশি ফুল ফুটতে দেখা যায়।

[আরও পড়ুন: জৈব সারের ব্যাবহার এর প্রকারভেদ এবং জৈব সারের উপকারিতা]

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *