টবে স্থলপদ্ম গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়ার উপায়

Last updated on October 21st, 2023 at 07:52 pm

হেমন্ত এবং বসন্ত, গ্রাম বাংলার অতীব জনপ্রিয় ফুলের নাম স্থলপদ্ম। এই ফুলের বিশেষত্ব হল দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে ফুলের রঙ পরিবর্তন হয়। এই বিশেষত্বের কারনে অনেকে বাড়ির আঙ্গিনায় অথবা টবে স্থলপদ্ম গাছ প্রতিস্থাপন করে থাকেন।

টবে স্থলপদ্ম গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়ার উপায় | How To Care & Grow For Hibiscus Mutabilis সম্পর্কে সম্পূর্ন তথ্য জানতে পারবেন। স্থলপদ্ম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus mutabilis, এটি মালভেসি (Malvaceae) পরিবারের অর্ন্তভুক্ত , ইংরেজি নাম -Cotton Rose বা Changeable Rose অথবা Chinese Rose হিসেবে পরিচিত। স্থলপদ্ম গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়।

টবে স্থলপদ্ম গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়ার উপায়

স্থলপদ্ম ফুলের রঙ পরিবর্তন, সকালে সাদা, দুপুরে হালকা সাদা-গোলাপি ছোপ ছোপ, বিকেলে হালকা গোলাপি, সন্ধ্যের আগে গাঢ় গোলাপি রঙ পরিবর্তনের এই আশ্চর্য খেলার জন্যই এই ফুল সকলের এত প্রিয়। স্থলপদ্মের অনেকগুলি ভ্যারাইটি আছে, একটি মাল্টি পেটাল এবং অপরটি সিঙ্গেল পেটাল। কিছু সিঙ্গেলপেটাল এবং মাল্টিপেটালের ফুলগুলি দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে রঙের পরিবর্ত করে, আবার কোনটি করে না। এটি বহুবর্ষজীবী এবং পর্ণমোচী প্রকৃতির উদ্ভিদ। তবে আজ আমি আপনাদের সাথে স্থলপদ্ম গাছের পরিচর্যা নিয়ে আলোচনা করব, সৌন্দর্য্যের বিচারে স্থলপদ্মের তুলনা হয় না। রূপে রঙে অপূর্ব সৌন্দর্য ফুলগুলি সবারই মন কেড়ে নেয়।

স্থলপদ্ম গাছ প্রতিস্থাপনের প্রথম বছরেই ফুল আসে, অর্থাৎ বছরে দুই বা একাধিক বার ফুল ফোটে । স্থলপদ্ম শরৎ ঋতুর ফুল হলেও, ফোটার ব্যাপ্তি হেমন্তকাল অবধি ইংরেজি মাস(September to October) দ্বিতীয়ত বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটলে ইংরেজি মাস(March to April)। স্থলপদ্ম ফুল নমনীয় কোমল অসংখ্য পাপড়ির সমন্বয়ে গঠিত হয়। এটি গন্ধহীন হলেও এর আকার এবং সৌন্দর্য অতুলনীয়। আকার-আকৃতিতে দেখতে আবার ঝুমকো জবা ফুলের ন্যায়। বর্ধনশীল শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে পত্রকক্ষ থেকে বোঁটায় ফুল ধরে। ফুল ঊর্ধ্বমুখী এবং ফুল ফোটার পূর্ব সময় পর্যন্ত ফুলের কলিদ্বয় ঊর্ধ্বমুখী থাকে।

টবে স্থলপদ্ম গাছ থেকে প্রচুর ফুল পাওয়ার উপায়

সরাসরি মাটিতে স্থলপদ্ম গাছ প্রতিস্থাপন করলে এমনিতেই প্রচুর ফুল পাওয়া যায়। কিন্তু এই গাছ টবে করলে কিছু সহজ অথচ সামান্য পরিচর্যা করলে একটি গাছ থেকে মরসুমে প্রচুর ফুল পাওয়া সম্ভব হয়। এবার সেই ‘বিশেষ পরিচর্যা’ গুলো কী এবং সেগুলো কীভাবেই বা করতে হয়—সেগুলোই পয়েন্ট ধরে ধরে আলোচনা করছি..

প্রথমবার গাছ বসানোর জন্য আপনি কাছের নার্সারি থেকে চারা গাছ সংগ্রহ করতে পারেন, দ্বিতীয়ত আপনি নিজে স্থলপদ্ম গাছের ডাল থেকে চারা তৈরী করতে পারেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন “স্থলপদ্ম গাছের চারা তৈরি এখন আরো সহজ“। নার্সারি থেকে চারা গাছ সংগ্রহের সময় আপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে ভালো ও সুস্থ চারা নির্বাচনের জন্য। গাছটি যেন বেশ হৃষ্টপুষ্ট ও সতেজ হয়। চারা যেন এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতার হয় এবং গাছে যেন কমপক্ষে তিন বা চারটি ডাল থাকে। প্রত্যেকটি ডালের মাথায় যেন সবুজ আভা ও কচি পাতা থাকে। যেকোনো নার্সারি থেকে আপনি উন্ন্যত মানের চারা সংগ্রহ করতে পারেন, দাম ২০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই। স্থলপদ্মের চারা বারো মাসই নার্সারিতে পাওয়া যায়, চারাগাছ বসানোর আদর্শ সময় বর্ষা থেকে শরৎ অথবা বসন্ত।

স্থলপদ্ম গাছের জন্য মাটি প্রস্তুত:

স্থলপদ্ম জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং জলনিকাশের সুবিধাযুক্ত হালকা দোআঁশ মাটি পছন্দ করে। টবের মাটি হালকা ভেজা ভাব তার খুব পছন্দের কিন্তু গোড়ায় জল জমা পছন্দ করে না। টবে স্থলপদ্ম গাছ করবার জন্য বিশেষ ধরণের মাটি তৈরি করতে হবে, ৩০ শতাংশ দোআঁশ মাটি, ২০ শতাংশ বালি, ৩০ শতাংশ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং ২০ শতাংশ কোকোপিট, সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে এক চামচ নিমখোল, এক চামচ হাড়গুঁড়ো, এক চামচ শিংকুঁচি ভালো করে মিশিয়ে নিলেই স্থলপদ্মের জন্য এক্কেবারে আদর্শ মাটি তৈরি হয়ে যাবে।এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।

স্থলপদ্ম গাছের জন্য টবে নির্বাচন:

নার্সারি থেকে চারা গাছ সংগ্রহ করবার পর প্রথমে ৮ ইঞ্চি টবে প্রতিস্থাপন করবেন, যেহেতু এই গাছ খুব দ্রুত শেকড় ছড়ায় এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী; তাই খুব ছোট টবে একে বসালে এক বছরের মধ্যই শিকড় মাটির ওপরে উঠে এসে রিপটিং-এর বার্তা দেবে এবং বাড়-বৃদ্ধিও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। এই জন্য প্রথমেই ৮ ইঞ্চি টবে বসানো ভালো। পরবর্তী সময়ে বড় টবে বা বড় গামলা জাতীয় পাত্রে স্থানান্তর করতে হবে।

টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রাখবার জন্য টবে ছিদ্র আছে কি না তা নিশ্চিৎ করতে হবে, টব নির্বাচন হয়ে গেলে টবের নিচে খোরাম কুঁচি বা টব ভাঙার টুকরো দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে দিতে হবে। এর পর মাটি দিয়ে পাত্র অর্ধেক ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তাতে হাফ চামচ এপসম সল্ট সম্ভব হলে ছড়িয়ে দেবেন (সম্ভব না-হলে দরকার নেই), তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।

জল প্রয়োগ:

টবে স্থলপদ্ম গাছ প্রতিস্থাপন করলে গাছে জলের চাহিদা প্রচুর থাকে। জলের অভাব দেখা দিলে গাছের ফুল শুকিয়ে যায় বা কুঁড়ি গাছ থেকে ঝড়ে পাড়ে বা গাছ নেতিয়ে পড়ে বা পাতা গাছ থেকে ঝরে পড়ে প্রভৃতি। এজন্য গরমকালে সকালে এবং বিকেলে মাটি ঠান্ডা হয়ে যাবার পর প্রতিদিন দুবেলা করে গাছের গোড়ায় জল দিতে হবে। গরমকালে over watering হলেও কোন সমস্যা নেই। এই গাছ কষ্টসহিষ্ণু, অতিরিক্ত রোদ সে সহ্য করতে পারে, তবুও সন্ধাতে স্নান করিয়ে দিলে গাছের স্বাস্থ্য বজায় থাকে।

তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা:

স্থলপদ্ম গাছ রৌদ্র খুব ভালোবাসে তাই যেখানে দিনে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সরাসরি সূর্যের আলো পাই তেমন স্থানে টবটি রাখতে হবে। তবে গরমকালে টবের গাছগুলিকে দুপুরের তীব্র রোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। গরমকালে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে হয়ে গেলে গাছে দুবেলা জল দিতে হবে চেষ্টা করবেন গরমকালে গাছটিকে সেডের নিচে রাখবার। এই গাছের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সার প্রয়োগ:

ফুলের মরসুম শুরু হওয়ার আগে থেকেই গাছের মাটি পরিবর্তন এবং যত্ন নেওয়া প্রয়োজন, তাহলেই মরসুমে গাছ ফুলে ভরে যাবে। বর্ষার শেষে এবং শীতের শেষে এদের সারের প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে কারণ শরৎ এবং বসন্তের সময় গাছে প্রচুর কুঁড়ি আসতে শুরু করে। টবের গাছে প্রতি ১৫ দিনে একবার অল্প পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সেক্ষেত্রে ১৫ দিনে একবার করে ১ চামচ পরিমাণ NPK (10:26:26) সার গাছের গোড়া থেকে কিছুটা দূরে প্রয়োগ.করতে হবে।

অথবা প্রত্যেক মাসে একবার করে জৈব সার: দুমুঠো গোবর সার অথবা ভার্মি কম্পোস্ট এবং পরিমাণ সরষের খোল এবং ১ চামচ করে Micronutrients:Top Gold,Agromin Gold, Agromin Max ব্যাবহার করা যেতে পারে। মরসুমের আগে এদের সারের প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে কারণ এ সময় গাছে প্রচুর কুঁড়ি আসতে শুরু করে। এছাড়াও কলার খোসা, ডিমের খোসা, হাঁড় গুড়ো, শিং কুঁচি , পাতাপচা সার প্রভৃতি ব্যাবহারে প্রচুর ফুল পাওয়া যায় ।

রোগ এবং কীটপতঙ্গ:

স্থলপদ্ম গাছে তেমন রোগ দেখা যায় না। তবে মিলিবাগ এবং জাব পোকার উপদ্রব ভীষনভাবে হয়। এই দুটো পোকার আক্রমণ বেশি হলে প্রতিকার না-করলে গাছ মারা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এক লিটার জলে তিন এমএল শ্যাম্পু অথবা হাফ চামচ যে-কোন কোম্পানির বাসন মাজার তরল মিশিয়ে পর পর দু’দিন মেঘ মুক্ত দিনের সকালবেলা স্প্রে করে দিন, সব পোকা মরে যাবে।

মিলিবাগ দেখা মাত্রই ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। ইমিডাক্লোরোপিড নামক মূল উপাদানের তৈরি যে কোন কীটনাশক, ১ লিটার জলে পাঁচ ফোঁটা মিশিয়ে গাছে সন্ধাতে স্প্রে করবেন। মিলিবাগর আক্রমন হলে ৫ দিন অন্তর অন্তর মোট ৭ বার স্প্রে করতে হবে। এটি বাজারে মিডিয়া,কনসফিডার নামেও পাওয়া যায়। কনফিডার বাংলাদেশেও পাওয়া যায়।

ডাল ছাঁটাই:

ফুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে হার্ড প্রুনিং করতে পারেন। গাছ খুব বেশি লম্বা হয়ে উঠলে বছরের দুবার অথবা একাধিক বার হার্ড প্রুনিং করা যেতে পারে। ফুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কারণেই অল্পদিন ফুল দেওয়া বন্ধ রেখে বিশ্রাম নেয়। সেক্ষেত্রে এই বিশ্রামের সময়টুকু বেছে নিয়ে সেই সময় হার্ড প্রুনিং করবেন। প্রয়োজনে একই সময় রি-পটিং-ও করতে পারেন। এই গাছ বেশ কষ্টসহিষ্ণু গাছ, হার্ডপ্রুনিং এবং রি-পটিং দুটো একসঙ্গে করলেও এর কোন অসুবিধে হয় না।

স্থলপদ্ম ফুল ফোঁটার সময়:

স্থলপদ্ম গাছ প্রতিস্থাপনের প্রথম বছরেই ফুল আসে, অর্থাৎ বছরে দুবার ফুল ফোটে । স্থলপদ্ম শরৎ ঋতুর ফুল হলেও, ফোটার ব্যাপ্তি হেমন্তকাল অবধি ইংরেজি মাস(September to October) দ্বিতীয়ত বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটলে ইংরেজি মাস(March to April)।

[আরও পড়ুন: ঝিন্টি গাছে প্রচুর ফুল পেতে কি ভাবে পরিচর্যা করবেন]

বংশবিস্তার:

এই গাছের বংশবিস্তার করা হয় ডাল কাটিং প্রদ্ধতির মাধ্যমে। ডাল ছাঁটাই করবার পর অবশিষ্ট অংশ ফেলে না দিয়ে আপনি নিজে স্থলপদ্ম গাছের ডাল থেকে চারা তৈরী করতে পারেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন “স্থলপদ্ম গাছের চারা তৈরি এখন আরো সহজ“।

প্রিয় পাঠক, এই প্রতিবেদনটি পঠন করবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকের সহযোগিতা “ক্রিয়েটিভিটি গার্ডেনিং” সর্বদা কার্ম করে। গাছই আমাদের একমাত্র সম্পদ যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। নিঃস্বার্থে গাছ ভালবাসুন, সকলকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করুন।

আপনাদের যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে আমাকে জানাতে জানাবেন। সেগুলোর সমাধান করাবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, সবাই খুব ভালো থেকো নমস্কার।

আপনার মূল্যবান রেটিং দিয়ে উৎসাহিত করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *